ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম ॥ আশার প্রদীপ জ্বালি

সানজিদা আয়েশা

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৬ মে ২০২৫

হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম ॥ আশার প্রদীপ জ্বালি

দ্রুতগতির বল্গাহরিণের গতির মতোই প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের জন্য চিকিৎসা নামক মৌলিক চাহিদা পূরণ যেন এখন রীতিমতো এক দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়ের অমানিশা ও দারিদ্র্যের ধোঁয়াশার অন্ধকারে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম যেন একটি আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে।

১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম শুরু হয়ে বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর জেলা ও উপজেলার ৫৩৮টি ইউনিটে কার্যক্রম চলমান আছে।
অসহায় রোগীদের ভর্তি ও দিক নির্দেশনা প্রদান করতে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়গুলো কাজ করে। অসুস্থ প্রান্তিক মানুষগুলোর সামনে হাসপাতালগুলো যখন গোলকধাঁধাঁ হয়ে দাঁড়ায় তখন তথ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে আগতদের সহায়তা করে।

রোগ শুধু রোগীকে নয় মানসিকভাবে রোগীর স্বজনকেও দুর্বল করে ফেলে। এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং, মোটিভেশন ও ফলো-আপের মাধ্যমে তাদের সেবা প্রদান করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থাপনা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডঐঙ এর হিসাব অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবায় দিন দিন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে চিকিৎসায় বাংলাদেশে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৭৪ শতাংশ। এই ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ওষুধে ব্যয় হয়েছে ৪৪ শতাংশ।

গত এক বছরে হাসপাতালগুলোতে রোগনির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার ফি, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও ওষুধের ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর এক গবেষণা  থেকে জানা যায়  চিকিৎসা  সেবা নিতে  এসে  হাসপাতালে ভর্তি  হয়ে  ৬১  শতাংশ  মানুষ  অর্থ  সংকটে পড়েন।

একটি পরিবারের এক সদস্য হাসপাতালে ভর্তি হলে গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। এ খরচের প্রায় ২৫ শতাংশ ওষুধের পেছনে চলে যায়। এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী দরিদ্রসীমার মধ্যে প্রবেশ করেছে যা মোট দারিদ্র্যের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া প্রায় ২৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে স্বাস্থ্যসেবা নেন।
এখানেই ভূমিকা রাখছে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়গুলো। এসব অসহায় রোগীদের জন্য আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়গুলো বিনামূল্যে রক্ত, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ঔষধ ক্রয়ের ব্যবস্থা করছে।

দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে খাদ্য, বস্ত্র, চশমা, হুইল চেয়ার, ক্র্যাচ ইত্যাদি চিকিৎসা সামগ্রী  প্রদান করে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করার প্রয়াস চালাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর এর চিকিৎসা শাখার তথ্য অনুযায়ী গত ২০২৪ অর্থ বছরে আর্থিক ও সামাজিকভাবে ৭৬১৫৯৬ জন মানুষকে ২৭ কোটি ৩৬ লক্ষ ১৪ হাজার ৩৭৫ টাকা মূল্যের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া রোগীদের যাতায়ত ভাড়া প্রদান, লাশ পরিবহন, দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা এবং পরিত্যক্ত শিশু ও অন্যান্যদের  চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে কার্যালয়গুলো। এর মাধ্যমে হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মীরা তাদের কাজকে কর্মের গন্ডি ছাড়িয়ে সেবার উচ্চতায় আসীন করছে।
প্রতিটি হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ে রয়েছে একটি রোগীকল্যাণ সমিতি। সমাজের দানশীল, সচ্ছল, মানবিক মানুষের দান-অনুদান ও যাকাতের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হয়। সরকারও কিছু অনুদান প্রদান করে। এভাবেই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়গুলো নিরন্তর কাজ করে চলেছে।
কিন্তু এখানে কর্মকর্তারা অনেক সময়ই কাজ করতে গিয়ে মনোবল হারান। অতিমারি করোনার সময় সামনের সারিতে থেকে সেবা দিয়েছেন তাঁরা, নিজেরা ও পরিবারের সদস্যরা মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করেছেন কিন্তু কর্মীরা ঝুঁকিভাতা বা অন্য কোন সহায়ক সুবিধা পাননি।
তবে এই কার্যক্রম যতটুকু ভূমিকা রাখতে সক্ষম ঠিক ততটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে না বেশ কিছু কারণে। প্রতিটি হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ে যথেষ্ট জনবল সংকট রয়েছে, সরকারি অনুদানের পরিমাণ অপ্রতুল বিধায় কার্যক্রমটি অনেকটাই মানুষের দানের উপর নির্ভরশীল।
হাসপাতাল সমাজসেবার নীতিমালা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। দান অনুদানের উপর কর রেয়াত করা হলে আরও গতিশীলতা তৈরি হতো এই কার্যক্রমের। দেশের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে এই কার্যক্রমের কলেবর ও আওতার আরও বৃদ্ধি ঘটত, অনেক অসহায় মানুষের কষ্ট লাঘব হত।
কবি আবদুল কাদির তার মানুষের সেবা কবিতায় বলেছিলেনÑ
‘বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,
তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে’  
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস বাদশাহ নমদারে  বাদশাহ হুমায়ুনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আল্লাহ কোথায় থাকেন। বাদশাহ উত্তরে বলেছিলেন তিনি থাকেন ব্যথিত মানুষের হৃদয়ে। সমাজের আর্ত-পিড়ীত, ব্যথিত মানুষের জন্য আমাদের সকলের প্রাণ নিবেদিত হোক।
 লেখক : কর্মকর্তা, সমাজসেবা অধিদপ্তর

 

×