
মানবিক করিডর হলো এক ধরনের অস্থায়ী অসামরিকীকরণ অঞ্চল, যা একটি সংকটপূর্ণ অঞ্চলে মানবিক সহায়তার নিরাপদ পরিবহন এবং/অথবা শরণার্থীদের বের করে আনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়।
বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোয় যেখানে মানুষ খাদ্য ও ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না, তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিশ্বের যেসব জায়গায় এমন মানবিক করিডর হয়েছে তার কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনোটি তৃতীয় পক্ষ- বিশেষ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন একটি স্বীকৃত পথ বা প্যাসেজের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। সংঘাতময় এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর এমন পথ বা পদ্ধতিই মানবিক করিডর।
মূলত জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন রেজুলেশন (৪৬/১৮২ এবং ৫৮/১১৪) এ মানবিক নীতিকে অনুমোদন করা হয়েছিল। আর নিরাপদ মানবিক করিডরের অর্থের সংজ্ঞায় সংস্থাটি বলেছে জরুরি সরবরাহের জন্য একটি প্যাসেজ।
এমন একটি মানবিক করিডরের মধ্য দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে। জাতিসংঘের সনদ অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সম্মতিতে মানবিক সহায়তা দেওয়া উচিত। এটি হবে একটি অসামরিক জোন, একটি নির্দিষ্ট এলাকা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো তাতে সম্মত হতে হবে।
আর রেডক্রস মানবিক করিডরের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমোদন করা নিরাপদ প্যাসেজ।
বেসামরিক নাগরিকদের সংঘাতময় এলাকা ত্যাগ করা, মানবিক সহায়তা সামগ্রী আনা বা নেয়া কিংবা আহত, অসুস্থ বা নিহতদের সরানোর জন্য এটি ব্যবহার করার অনুমোদন তারা দিতে পারে। সংস্থাটি বলছে, গত কয়েক দশকে মানবিক করিডর লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) তাদের ওয়েবসাইটে মানবিক করিডরের বিষয়ে বলছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতিতেই একটি করিডরে প্রবেশাধিকার ও এর সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
তবে অনেক ক্ষেত্রে বিবদমান পক্ষগুলোকে রাজি করাতে না পারলে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেক সময় এমন প্যাসেজ বানায়, যেখানে বিবদমান সব পক্ষকে সরিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা দেয়া হয়।
সংঘাতময় অঞ্চলে জরুরি পণ্য পাঠাতে মানবিক করিডরের প্রয়োজন হয় অনেক সময়। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতায় তীব্র মানবিক সংকটে পড়া মানুষদের জন্য সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডর বারবার আলোচনায় এসেছে।
বাংলাদেশে এটি আলোচনায় এসেছে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর প্রসঙ্গে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে সংঘাতময় এলাকায় এ ধরনের করিডর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দেখা গেছে।
মানবিক করিডর প্রদান করা হলে আসলে ঝুঁকি কতটুকু? যেসব দেশে মানবিক করিডর পরিচালিত হয়েছে এমন অনেক জায়গাতেই অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। অনেক জায়গায় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষ এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে।
এমনকি এমন মানুষদের বহনকারী একটি কনভয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পর্যন্ত হয়েছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় সিভিলিয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডরে থাকা সেতু উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
গবেষকরা মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখল করা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এনআরসি বলছে এ ধরনের করিডরের সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকার অনেকটা সীমিত থাকে। যে এলাকায় সংঘাত হয় সেখানে নির্দিষ্ট মানবিক করিডরে নিরাপদে পৌঁছানোও ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়।
তাদের মতে এ ধরনের করিডরের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত থাকা উচিত। অর্থাৎ এটা কি ত্রাণসামগ্রী বা জরুরি সহায়তার জন্য, নাকি বেসামরিক নাগরিকদের সংঘাতময় এলাকা ত্যাগের জন্য, নাকি উভয় উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে সেটার পরিষ্কার ঘোষণা থাকা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নতুন কে নো ধারণা নয়। বরং বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে মানবিক করিডরের প্রচলন শুরু হয়। নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল ১৯৩৮-৩৯ সালে। নিরাপত্তা পরিষদের নেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডর স্থাপিত হলেও সেটি দুই বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিল আজারবাইজান সরকার। আবার ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে তার কোনো রূপরেখা ছিল না।
ফলে পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ১৯৯৫ সাল নাগাদ সেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটি ইউরোপের ভয়াবহ নৃশংসতার একটি।
ইথিওপিয়ায় টাইগ্রে অঞ্চলে বহু মানুষ মাসের পর মাস সরকারি অবরোধে আটকে পড়লে ২০২২ সালের নভেম্বরে মানবিক করিডরগুলো পুনরায় চালুর মধ্য দিয়ে তাদের প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হয়।
মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডর দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে; বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এই তথ্য প্রকাশের পর মানবিক করিডর ইস্যুটি নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মানবিক করিডর বিষয়ে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাখ্যা দাবি করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।
যদিও মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে। যদি রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রাজি হবে, এটাই আমাদের অবস্থান, বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হলো মিয়ানমার এর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের মানবিক করিডর প্রদান করলে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে? বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন, এ ধরনের করিডোর প্রদান করা হলে, বিভিন্ন পক্ষ অপব্যবহার করতে পারে। যেমন- জঙ্গি সমস্যা মাথা ছাড়া দিতে পারে।
অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান এর আন্তর্জাতিক রুট হিসাবে এই করিডর ব্যবহার হতে পারে। কেউবা মনে করেন ভারত চায়না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের হীন স্বার্থে গোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করতে পারে।
অনেকে মনে করেন, এ ধরনের করিডোর প্রদান করা হলে, বিবাদমান আরাকান আর্মি মিয়ানমার এর সরকার বিরোধী গ্রুপ হওয়ায়, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে, বাংলাদেশ ইয়াবার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে পারে, কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশে ইয়াবা কারবার এর একমাত্র উৎস মিয়ানমার।
এর ফলে বাংলাদেশের যুবসমাজ আরও বেশি নেশার অতল গহবরে নিমজ্জিত হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ও চরম অবনতি হবে।
বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে। বিষয়টিকে অনেকে সাধুবাদ জানালেও, কেউবা এর সমালোচনাও করেছেন।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ায় যা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সংগঠন, এবং গত হওয়া সরকার গুলি ও বর্তমান সরকারও আন্তর্জাতিক যে কোনো সমস্যায় মানবিকতার পরিচয় দিয়ে আসছেন।
মানবিকতার দিক থেকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সুখ্যাতি রয়েছে। অন্যদিকে আমরা বাংলাদেশীরা নিজেদের মধ্যকার এর বৈপরিত্য। ফলশ্রুতিতে আমরা দ্বিধাবিভক্ত জাতি হওয়ার দিকে এগুচ্ছি।
এ অবস্থায় আবেগের বশবর্তী না হয়ে, বাংলাদেশের নিজের স্বার্থে মানবিক করিডর প্রদান এরবিষয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল
কুতুবে রব্বানী