
ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। এমনিতেই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে থাকা দেশে এই ধাক্কা নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে শ্রমিকদের মধ্যে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর বাংলাদেশ বিশৃঙ্খলার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল।নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার যখন অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, তখন এক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এল আরেকটি ধাক্কা — বাংলাদেশের পণ্যের উপর ৩৭ শতাংশ নতুন শুল্ক ঘোষণা।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেটি জ্বালানি, খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা পূরণে রপ্তানি আয়ের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এমন শুল্ক কার্যত ধ্বংসাত্মক।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত সেই শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত করলেও আগামী জুলাইয়ে তা পুনরায় কার্যকর হতে পারে—এ আশঙ্কা পোশাক খাতের লাখো শ্রমিকের মনে ভয়ের সঞ্চার করেছে।
২৫ বছর বয়সী মুরশিদা আখতার, উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকার কাছে এসে কাজ করা এক গার্মেন্ট শ্রমিক। সম্প্রতি তিনি সাভারের ৪এ ইয়ার্ন ডাইং ফ্যাক্টরিতে নতুন চাকরি নিয়েছেন। আগের চেয়ে সামান্য বেশি বেতন—প্রায় ১৯ হাজার টাকা, ভালো পরিবেশ এবং কম দূরত্ব তবু তার মনটা উৎকণ্ঠায় ভরা।
“আমার ভয়, অর্ডার কমে যাবে। তখন কাজও কমে যাবে,” বললেন মুরশিদা।
বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের অর্থনীতি অনেকাংশেই দাঁড়িয়ে আছে এই পোশাক শিল্পের উপর। ১৯৭০ এর দশকে স্বাধীনতা-পরবর্তী দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি এখন গ্লোবাল গার্মেন্ট হাবে পরিণত। নারী শ্রমিকদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই শিল্পই বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়েও এগিয়ে দিয়েছে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শুল্ক এই অগ্রযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
প্রায় ৪০ লাখ বাংলাদেশি সরাসরি গার্মেন্ট খাতে কর্মরত। পরোক্ষভাবে এই সংখ্যা ২ কোটি ছুঁতে পারে। তারা সবাই এখন উদ্বিগ্ন এই শুল্ক যদি ফিরে আসে, তাহলে রপ্তানি কমবে, কাজ হারানোর শঙ্কা তৈরি হবে।
বিশ্বব্যাপী চীনকে লক্ষ্য করে ট্রাম্প প্রশাসনের ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ এবং বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক উভয়ই এই খাতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এক চিঠিতে ৯০ দিনের অবকাশ চেয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা সহ অন্যান্য পণ্য বেশি কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এই শুল্ক হুমকিকে বলছেন “ক্ষমতার কুৎসিত প্রদর্শনী।” তার মতে, এমন সময়ে এই সিদ্ধান্ত এসেছে যখন বাংলাদেশ রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনীতি দুর্বল।
২০২৪ সালে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এরপর দেশে শুরু হয় নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর নতুন সরকারকে ঘিরে সংশয়।
তবে গার্মেন্ট খাত এই সময়েও চুপ করে বসে নেই। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এই শিল্পে নিরাপত্তা ও টেকসই উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘লিড’ (LEED) সনদপ্রাপ্ত ২৩০টি পরিবেশবান্ধব গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি রয়েছে যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
সাভারের ৪এ ইয়ার্ন ডাইং ফ্যাক্টরিটি এর মধ্যে অন্যতম। এখানে তৈরি হয় কারহার্ট থেকে ক্যালভিন ক্লেইনের মতো মার্কিন ব্র্যান্ডের আউটারওয়্যার। আমদানি-নির্ভর এই ফ্যাক্টরিতে সৌরশক্তি, প্রশস্ত ও পরিষ্কার কর্মপরিবেশ, নারী-বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মব্যবস্থা ও বিদেশি পরিদর্শকদের স্বচ্ছতা রয়েছে।
এই ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার ইমাম স্মরণ করলেন গত আগস্টে দেশে চলমান আন্দোলনের সময় হাজারো মানুষ তাদের ফ্যাক্টরি ঘেরাও করেছিল। তবে শ্রমিকদের সঙ্গে একত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিনি। এসময় তিনি তিনি গর্বকরে বলেন, এসময় একদিনও উৎপাদন বন্ধ হয়নি।
৪এ ইয়ার্ন ডাইং এর সাসটেইনেবিলিটি প্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন বলেন, “এই দেশের পুরো অর্থনীতি এই সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের একমাত্র সম্পদ শ্রম।”
তবে শুল্ক ফিরে এলে দেশে গার্মেন্টস শিল্পের এ পরিশ্রমের ভবিষ্যত আবার অনেক টাই অনিশ্চিত।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস
রবিউল হাসান