ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশের সঙ্গে অনলাইনে শেষ সভা

আইএমএফের বোর্ড সভায় কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্ত ২৩ মে

নাজমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ৬ মে ২০২৫

আইএমএফের বোর্ড সভায় কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্ত ২৩ মে

আগামী ২৩ মে ফের ওয়াশিংটনে আইএমএফ এর বোর্ড অনুষ্ঠিত হবে

আইএমএফ এর ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি এখন পুরোটাই নির্ভর করছে সংস্থাটির বোর্ড সভার ওপর। আগামী ২৩ মে ফের ওয়াশিংটনে আইএমএফ এর বোর্ড অনুষ্ঠিত হবে।
সোমবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় ঋণের পরের কিস্তি ছাড় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে অনলাইনে শেষ সভা করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।  বাংলাদেশ থেকে সভায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান।

বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি গভর্নর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আইএমএফ এর সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছে। গভর্নর তাতে অংশ নিয়েছেন।’ সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আলোচিত বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা তথ্য দিলেও নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
তিনি বলেছেন, ‘বিনিময় হার এখনই পুরোটা বাজারমুখী করার পক্ষে নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বক্তব্যটি ফের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর-হার বাড়ানো ও ভর্তুকি একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনাও এই মুহূর্তে সম্ভব না।’ ‘দুটি বিষয় পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ, তাতে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। সেই বক্তব্য যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা হয়।’ এই দুটি বিষয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিবর্তন করবে না, তা স্পষ্ট করেই বলা হয় আইএমএফকে। এখন আইএমএফ এর ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি পুরোটাই নির্ভর করছে সংস্থাটির বোর্ড সভার ওপর।
আগামী ২৩ মে ওয়াশিংটনে আইএমএফ এর বোর্ড অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকেই ঋণের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসবে। এবার চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে বাংলাদেশকে মোটা দাগে কয়েকটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট শর্ত হচ্ছে, মুদ্রানীতির আরও সংকোচন, মুদ্রার বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা, নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ।

রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। গত রোবাবর বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ হয় ২৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, বিপিএম পদ্ধতিতে তা ২১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এরপরে আইএমএফ এর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার পুরোটা বাজারমুখী করা, করহার বাড়ানো ও ভর্তুকি কমানো।

এখানেই আপত্তি করেছে বাংলাদেশ। আলোচনা এমন শক্ত অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে যে, বাংলাদেশ প্রয়োজনে আইএমএফ এর ঋণ কর্মসূচি থেকে বেড় হয়ে যাবে; তবু এ দুটি শর্ত বাস্তবায়ন করবে না আগামী জুন মাসের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, এই মুহূর্তে দুটি শর্ত বাস্তবায়নের চাপ নেওয়ার মতো জায়গায় নেই অর্থনীতি।
মুদ্রার বিনিময় হার এখনই বাজারমুখী করতে নারাজ বাংলাদেশ তা অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদও একাধিকবার বলেছেন। সবশেষ গত ২৯ এপ্রিল আইএমএফ এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বৈঠক শেষ করে এসে সচিবালয়ে বলেছিলেন, ‘ওরা ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা বলেছি একেবারে ওপেন করে দেওয়া যাবে না। পাকিস্তানের মতো ২৮০ টাকা, শ্রীলংকার মতো ৪০০ টাকায় পৌঁছে যাবে, সেটা আমি পারব না।’
‘বাংলাদেশে ম্যাক্রো ইকনোমিক স্ট্যাবিলিটি অনেক ভালো। আইএমএফ থেকে কোনো টাকা পয়সা না নিয়েই কিন্তু ফরেন রিজার্ভ স্থিতিশীল।’ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এ সরকার আসার পর আইএমএফ থেকে আর টাকা পাওয়া যায়নি। তাদের সহযোগিতা ছাড়াই আমরা স্থিতিশীল আছি। অতএব তারা যে শর্ত চাপিয়ে দেবে, সেটা পারবে না।’ এখন সমঝোতা হলে আগামী জুনে ঋণের পরবর্তী দুই কিস্তি একসঙ্গে পেতে পারে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক ঋণ দাতা সংস্থা আইএমএফ এর সঙ্গে চলমান ঋণের কিস্তি ছাড়ের আগে পর্যালোচনা সভা শেষ করেছে ঢাকা সফররত সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। সেখানে কোনো রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় সফর।
ঋণের প্রতিটি কিস্তি ছাড় করতে আইএমএফ তার আগের কিস্তির অর্থের ব্যবহার পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রয়োজনে শর্ত সংযোজন-বিয়োজন করে সংস্থাটি। তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের সময়ে রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার শর্ত শিথিল করেছিল আইএমএফ। আর্থিক সংকট সামাল দিতে ২০২২ সাল থেকে কয়েক দফা আলোচনা শেষে পরের ব্ছরের প্রথম দিকে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে বছর ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। তবে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, বিদেশি মুদ্রার নিট সঞ্চিতি বা রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্থার ঠিক করে দেওয়া শর্ত পরিপালন না করায় ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় করেনি আইএমএফ।  
২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখায় ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। আড়াই বছরে মার্কিন এই মুদ্রার দাম এই সময়ে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠেছে।
গত ডিসেম্বর মাসে ডলারের নির্দিষ্ট দাম ধরে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত উঠানামার একটি সীমা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন বলা হয়, ১২৩ টাকা পর্যন্ত ডলার লেনদেন করা যাবে। এখন ১২২ থেকে ১২৩ টাকা দরে ডলার বেচাকেনা করছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আইএমএফ এখন বলছে, বিদেশী মুদ্রার বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বাজারই নির্ধারণ করবে ডলারসহ বিদেশী মুদ্রার দাম কত হবে।

বাংলাদেশ তাতে রাজি নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রা বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া কঠিন। পুরোপুরি বাজারনির্ভর বিনিময়হার ব্যবস্থা চালু হলে যেকোনো সময় অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসতে পারে।
সাধারণত অর্থনীতি বিশেষ করে লেনদেন ভারসাম্য ভালো থাকে, তখন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হার উন্মুক্ত করার উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কয়েক মাস ধরে রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে। গত মার্চে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে। আবার রপ্তানি আয়ে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ছাড়া বাজেট-সহায়তা ও প্রকল্প-সহায়তাও ছাড় হচ্ছে। এসব কারণে ডলারের জোগান বেড়েছে।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে ডলারের পড়তি দাম বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমছে। ৩ বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের বেশি ছিল। এর পর ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের এ বছর তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারে নেমে আসে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দামও কমেছে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এখন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হার বাজারের ওপর ছেড়ে না দিলে আর কখন করা হবে? কারণ, এখন লেনদেনের ভারসাম্য ভালো আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারে দাম কমেছে, অন্যান্য পণ্যের দামও পড়তি। আমদানি চাহিদাও কম, তাই চাপ আসার শঙ্কা কম।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বৈশ্বিক পরিম-লে এক ধরনের নেতিবাচক বার্তা যাবে। বিভিন্ন ঋণমানকারী প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় বাংলাদেশের মান কমে যেতে পারে। আবার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশ আস্থা হারাতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে যে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ডলারের বাজেট-সহায়তার আলোচনা চলছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ব্যাংকিং খাত, করব্যবস্থা, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বিনিময়হার নীতিসহ যেসব অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে করা যায়নি। আইএমএফের কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে ওই সব সংস্কার করা তুলনামূলক সহজ হবে। এ ছাড়া বহির্বিশ্বে একধরনের বার্তা যাবে, বাংলাদেশের পাশে আইএমএফ আছে। জাহিদ হোসেন মনে করেন, ঋণ কর্মসূচিতে থেকে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করা ভালো হবে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ বার আইএমএফের কাছ থেকে ছোট-বড় ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে সর্বশেষ নেওয়া বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) ১০০ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। সব কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এর আগে কোনো ঋণ কর্মসূচিই পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০০৩ সালে দারিদ্র্যবিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সহায়তা (পিআরজিএফ) কর্মসূচিতে ৪৯ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাক্সিক্ষত সংস্কার না হওয়ায় তিন কিস্তি পাওয়ার পর বাকি তিন কিস্তি স্থগিত করেছিল আইএমএফ।
এ ছাড়া ১৯৯১ সালে আরেকটি ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে অর্থনৈতিক সংস্কারে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মাঝপথে স্থগিত হয়। পরের ১০ বছর আইএমএফের সঙ্গে কোনো ঋণ কর্মসূচিতে যায়নি বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে আইএমএফের কাছে থেকে প্রথম প্রায় চার কোটি ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ।

আরো পড়ুন  

×