ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

ড. ইউনূসসহ চার উপদেষ্টার সঙ্গে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক

সমঝোতা স্মারক সই, নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ কমিটি গঠন

কূটনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৯, ৭ মে ২০২৫

সমঝোতা স্মারক সই, নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ কমিটি গঠন

উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও মাতেও পিয়ন্তেদোসি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন

বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং বৈধ অভিবাসন উৎসাহিত করার জন্য ইতালির সঙ্গে অভিবাসন ও সচলতা মোবিলিটি সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই এবং আন্তর্জাতিক সংগঠিত অপরাধ প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠনে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ।
মঙ্গলবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং সফররত ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি ঢাকায় এই সমঝোতা স্মারক সই করেন।
এর পাশাপাশি উভয় পক্ষ সফর উপলক্ষে এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় ‘এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল ছিল দুই দেশের সরকারের মধ্যে অভিবাসন ও মোবিলিটি সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক এমওইউ সই করা। বাংলাদেশের পক্ষে এই সমঝোতা স্মারক বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, রেমিটেন্স প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং বৈধ অভিবাসন পথের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।

অপরদিকে ইতালির ক্ষেত্রে, এটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত অভিবাসনকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি শ্রম ঘাটতির চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান দিয়েছে। এই সমঝোতা স্মারক ২০১৭ সালে বাংলাদেশ এবং ইইউর মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘অনুমোদন ছাড়া অবস্থানকারী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং প্রত্যাবর্তনের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি’র বিধানগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে যৌথভাবে এবং আরও কার্যকরভাবে অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলায় সহায়তা করবে।

ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি ৫-৬ মে বাংলাদেশে সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছেন। সফরকালে তিনি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি বিষয়ক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর (অব) সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।
উভয় পক্ষই ইতালির সরকার প্রধানের দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ সফরের আয়োজনের বিষয়ে একমত হয়েছে। সফরকালে উভয়পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবস্থা পর্যালোচনা করে এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা, অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, আইন প্রয়োগকারী সহযোগিতা, সুগম ভিসা প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা এবং ইতালিতে বাংলাদেশী প্রবাসীদের কল্যাণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

উভয় পক্ষই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং তাদের জনগণের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক উপকারী অংশীদারত্ব গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ ও ইতালির অভিন্ন আকাক্সক্ষার প্রতিফলনের বিষয়ে আলোচনা করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক ॥ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পিয়ান্তেদোসি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংস্কারের জন্য ইতালির অব্যাহত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
ইতালিকে বাংলাদেশের একটি মূল্যবান অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন, যার মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর বাজার সুবিধা, ব্যবসা থেকে ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব এবং বস্ত্র, চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো খাতে যৌথ উদ্যোগ।

তিনি উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য শক্তি, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, অভিবাসন এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ, বিশেষ করে যুবসমাজের সঙ্গে বর্ধিত সহযোগিতার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করার ওপরও জোর দেন।
প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক ॥ বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ইতালির মন্ত্রী শ্রম গতিশীলতার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। ইতালিতে দক্ষ শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং বাংলাদেশের সুপ্রশিক্ষিত, পরিশ্রমী এবং তরুণ কর্মী সরবরাহের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা বৈধ অভিবাসন পথের আওতায় দক্ষ এবং কম-দক্ষ বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য বর্ধিত কোটা বিবেচনা করার অনুরোধ করেন। উভয়েই দক্ষতা উন্নয়ন উদ্যোগ বৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট উপায় অনুসন্ধানে সম্মত হন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক ॥ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠককালে তারা যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বৈধ অভিবাসন পথ উন্নত করার এবং অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ঢাকায় ইতালি দূতাবাসের সঙ্গে ঝুলে থাকা ভিসা আবেদনের সমস্যা, বিশেষ করে যাদের প্রকৃত ওয়ার্ক পারমিট আছে, দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি ইতালির প্রাদেশিক ইমিগ্রেশন অফিস কর্তৃক ওয়ার্ক পারমিট যাচাই দ্রুত করার জন্য উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে বের করার অনুরোধ করেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক ॥ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়েই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মানবপাচার এবং অভিবাসী চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদ এবং সাইবার অপরাধসহ আন্তঃদেশীয় সংঘটিত অপরাধ মোকাবিলায় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছেন।

তারা উভয় দেশের নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, অব্যাহত তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি এবং যৌথ প্রশিক্ষণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। পিয়ান্তেদোসি অবৈধভাবে আগতদের প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা জোরদার করার গুরুত্বের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
উল্লেখ্য, সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় বৈঠকে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠন করা হয়। বৈঠকে ইতালির পক্ষে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশে সফররত ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি।
ইতালির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শ্রমিকরা খুব পরিশ্রমী ও দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্ব¡পূর্ণ অবদান রাখছে। দেশটি নতুন করে বৈধ পথে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে আগ্রহী। তবে অন্য দেশের ভিসা নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার প্রবণতাকে তারা সম্পূর্ণরূপে নিরুৎসাহিত করেছে ইতালি।
ইতালি অবৈধ অভিবাসন ও মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছে ও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে বলে জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা নিরাপত্তা খাতেও সহায়তা বৃদ্ধি করার কথা জানিয়েছে। 
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যে  যে সকল বাংলাদেশী অবৈধভাবে ইতালিতে গমন করেছেন, তাদেরকে  যেন উপযুক্ত  প্রক্রিয়ায়  বৈধতা  দেওয়া হয়- সে বিষয়েও ইতালিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল  মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব) বলেন, ইতালির পুলিশ মাফিয়া চক্রসহ সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনে পারদর্শী। সেজন্য তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের প্রশিক্ষণ ও সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে চায়। তিনি বলেন, বৈঠকে আমরা পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও কোস্টগার্ডের দক্ষতা ও সামর্থ্য  বৃদ্ধিতে ইতালির সহায়তা কামনা করেছি।
বৈঠকে অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধ, অভিবাসন সংত্রান্ত অপরাধ নেটওয়ার্ক দমনে বাংলাদেশ কর্তৃক  গৃহীত নীতি ও কর্মপন্থা, অপরাধ দমন ও বিচার প্রক্রিয়ায় দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার এবং নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতা সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়।
দ্বিপাক্ষিক  বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী  মো. খোদা বখস চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি প্রমুখ এবং ইতালির পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত এন্তোনিও এলেসান্দ্রু, ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাডভাইজার  মেক্রো ভিলানী ও  ডেপুটি হেড অব কেবিনেট  সাবিনা ম্যাডারো, ইমিগ্রেশন ও বর্ডার পুলিশের  সেন্ট্রোল ডিরেক্টর ক্লোডিও গেলজারেনো প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে পৌঁছলে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

 

আরো পড়ুন  

×