
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের নিরীহ জনগণ যখন প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে লিপ্ত, তখন তাদের রক্ত নিয়ে যেন যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মেতেছে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী— ভারত ও পাকিস্তান। সম্প্রতি ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে।
এই হামলার দায় সরাসরি পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত গত মঙ্গলবার (৬ মে) দিবাগত রাতে অর্থাৎ বুধবার (৭ মে) প্রথম প্রহরে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের একাধিক স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পাকিস্তানের কোটলি, ভাওয়ালপুর, মুরিদকে, বাগ ও মুজাফফরাবাদে এই হামলায় শিশুসহ অন্তত ৩ জন নিহত এবং আরও ১২ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, ‘অপারেশন সিদুঁর’ নামে চালানো এই অভিযান ছিল সম্পূর্ণরূপে লক্ষ্যনির্ভর এবং পরিমিত। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলায় শুধুমাত্র সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে—কোনো সামরিক স্থাপনাকে নয়। পাকিস্তান যদিও ভারতীয় এই পদক্ষেপকে ‘কাপুরুষোচিত’ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং পাল্টা জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এ ঘটনায় কাশ্মীর সীমান্তজুড়ে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তত নয়টি স্থানে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। মুজাফফরাবাদসহ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসন জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১০০ কোটি পাকিস্তানি রুপি তহবিল বরাদ্দ করেছে এবং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে খাদ্য, পানি ও ওষুধ সরবরাহ করেছে।
এদিকে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বিরাজ করছে আতঙ্কের পরিবেশ। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পাহাড়ি চুরান্দা গ্রামের স্কুলশিক্ষক ফারুক আহমদ সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অভিভাবকদের মধ্যে ভয়ের মাত্রা তীব্র। গ্রামবাসী আবদুল আজিজ বলেন, ‘দেড় হাজার মানুষের জন্য ছয়টি বাংকার আছে। যদি উত্তেজনা বাড়ে, আমরা কোথায় যাব? প্রতিবার এই গ্রামটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ গত কয়েক দশকে শুধু চুরান্দা গ্রামেই দুই দেশের গোলাগুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৮ জন।
সীমান্তের ওপারে-পারে সেনাদের মুখোমুখি অবস্থান, পাল্টাপাল্টি হুমকি ও হামলায় নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র টেলিভিশনে জানান, ভারত পাকিস্তানের তিনটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে এবং তারা উপযুক্ত জবাব দেবে।
এর আগে এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সোমবার (৫ মে) নিউইয়র্কে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে পরিষদের সদস্যরা দুই দেশকে সামরিক সংঘাত এড়িয়ে সংলাপ ও কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “এখন সংযত থাকার সময়। যেকোনো সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।”
কিন্তু ইতিহাস জানে, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তান এর আগেও যুদ্ধ করেছে— আর প্রতি উত্তেজনায় প্রাণ দিতে হয়েছে সীমান্তের সাধারণ মানুষকেই। আজও কাশ্মীরিদের রক্ত বইছে দুই দেশের দম্ভের রাজনৈতিক খেলায়। কাশ্মীরিদের চাওয়া যেন গর্জে ওঠা কামানের আওয়াজ না ঢেকে দেয় আখরোটগাছের পাতার নড়াচড়া কিংবা পাখির ডাক।
কাশ্মীর সীমান্তের দুই পারের মানুষ জানে, যুদ্ধের দাম শুধু রাজনীতি নয়, চরমে গিয়ে দেয় তাদের জীবন, ঘর আর ভবিষ্যতের উপর। এখন প্রশ্ন, এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় কাশ্মীরিরা কি কেবলই বলির পাঁঠা?
এম.কে.