ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

সকালে বেশি কফি খাওয়া কি শরীরের ক্ষতি করে? বিকল্প কী হতে পারে?

প্রকাশিত: ১০:৫২, ৫ জুলাই ২০২৫

সকালে বেশি কফি খাওয়া কি শরীরের ক্ষতি করে? বিকল্প কী হতে পারে?

ছ‌বি: সংগৃহীত

সকালের শুরুতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি অনেকের কাছে দিনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় রিচুয়াল। এক কাপ কফি না খেলে যেন ঘুম ভাঙে না, কাজে মন বসে না, এমনকি দিনটাই যেন মাটি হয়ে যায়— এমনটা বহু মানুষ বলে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সকালে অতিরিক্ত কফি খাওয়া কি শরীরের জন্য ভালো, না কি এতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ক্ষতি হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের আগে বুঝতে হবে কফির উপাদান, শরীরের ওপর তার প্রভাব এবং স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্পগুলো কী হতে পারে।

কফির প্রধান উপাদান হলো ক্যাফেইন, যা একটি প্রাকৃতিক উত্তেজক (stimulant)। এটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে, মানসিক সতর্কতা বাড়ায়, ক্লান্তি দূর করে এবং সাময়িকভাবে কর্মক্ষমতা বাড়ায়। এজন্য সকালের ঘুমঘুম ভাব কাটাতে কফির জুড়ি মেলা ভার। তবে প্রতিটি উত্তেজকেরই যেমন কিছু সুফল আছে, তেমনি অতিরিক্ত সেবনের ফলে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। বিশেষ করে খালি পেটে কিংবা সকালে খুব বেশি কফি পান করলে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

প্রথমত, খালি পেটে কফি খাওয়ার ফলে পাকস্থলীতে অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। কফি প্রাকৃতিকভাবে অ্যাসিড উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে, ফলে যাদের গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তাদের জন্য সকালে বেশি কফি খাওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। এটি পেটে জ্বালাপোড়া, অম্বল, এমনকি আলসার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেক সময় এটি সকালে খাওয়ার আগ্রহ কমিয়ে দেয়, যা দিনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত ক্যাফেইন ঘুমের চক্রকে ব্যাহত করে। সকালে অনেকেই কয়েক কাপ কফি পান করেন এবং দিনের অন্যান্য সময়েও তা চালিয়ে যান। এতে শরীরে ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি থাকলে রাতে ঘুমে সমস্যা হয়, ঘুম গভীর হয় না অথবা বারবার ঘুম ভেঙে যেতে পারে। নিয়মিতভাবে এমনটি ঘটলে ক্লান্তি, মানসিক অবসাদ, মনোযোগের ঘাটতি ও উদ্বেগের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তৃতীয়ত, অতিরিক্ত কফি পান করার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। অনেকে খেয়াল করেন, কয়েক কাপ কফি খাওয়ার পর তাদের বুক ধড়ফড় করে, ঘাম হয়, অথবা এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। বিশেষ করে যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি আছে, তাদের জন্য এটি একেবারেই নিরাপদ নয়। এ ছাড়া কফিতে উপস্থিত ক্যাফেইন রক্তচাপও সাময়িকভাবে বাড়িয়ে দেয়, যা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

চতুর্থত, ক্যাফেইন আসক্তি তৈরি করতে পারে। একবার এই অভ্যাস গড়ে উঠলে তা ছাড়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই এক বা দুই দিন কফি না খেলেই মাথাব্যথা, ঝিমুনি, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অথবা এক ধরনের অবসাদ অনুভব করেন। এটি প্রমাণ করে যে শরীর ক্যাফেইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা আদতে কোনো স্বাস্থ্যকর অভ্যাস নয়।

এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে— তাহলে সকালে জেগে ওঠার জন্য বা মন চাঙ্গা রাখার জন্য আমরা কী বিকল্প নিতে পারি? সৌভাগ্যবশত, কফির বিকল্প হিসেবে অনেক স্বাস্থ্যকর পানীয় রয়েছে, যেগুলো আমাদের সকালকে চাঙ্গা করতে পারে এবং একইসাথে শরীরের জন্য উপকারীও।

সবচেয়ে সহজ এবং উপকারী বিকল্প হলো গরম পানি অথবা লেবু মিশ্রিত গরম পানি। সকালে এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে অল্প লেবুর রস মিশিয়ে খেলে এটি শরীরকে ডিটক্স করতে সহায়তা করে এবং হজম প্রক্রিয়া শুরু হয় সহজে। এতে ক্যাফেইনের মতো উত্তেজক না থাকলেও শরীর সতেজ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে অনেক বেশি স্বাস্থ্য উপকার পাওয়া যায়।

আরেকটি বিকল্প হলো হারবাল চা বা ভেষজ চা। গ্রিন টি, তুলসি চা, আদা চা, অথবা ক্যামোমাইল চায়ের মতো পানীয়গুলো শরীরকে চাঙ্গা করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। এগুলোতে ক্যাফেইন অনেক কম থাকে বা একেবারেই থাকে না, ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না বা আসক্তিও তৈরি হয় না।

এ ছাড়া অনেকে সকাল শুরু করতে পারেন ফলের স্মুদি দিয়ে। কলা, আপেল, ওটস, দুধ কিংবা বাদামের দুধ দিয়ে তৈরি স্মুদি শুধু যে পুষ্টিকর তা-ই নয়, বরং এটি শক্তি জোগায় এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে। এতে সকালবেলার মেটাবলিজম বাড়ে এবং দেহে শক্তি সঞ্চার হয় প্রাকৃতিক উপায়ে।

নিয়মিত ব্যায়াম বা হালকা স্ট্রেচিংও সকালের ঘুম কাটাতে দারুণ কার্যকর। ব্যায়াম করলে শরীরে এন্ডরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের মনোভাব উন্নত করে এবং প্রাকৃতিকভাবেই সতেজ করে তোলে। এজন্য এক কাপ কফির বদলে ১০-১৫ মিনিটের হাঁটা বা হালকা যোগব্যায়াম অনেক বেশি উপকারী হতে পারে।

অবশেষে বলা যায়, কফি খারাপ নয়, কিন্তু তার মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক ১-২ কাপ কফি সাধারণত কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না, বরং কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। তবে খালি পেটে কিংবা অতিরিক্ত কফি পান শরীরের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। যারা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সচেতন, তাদের উচিত কফির উপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা।

সকালের শুরুটাই যদি সঠিক হয়, পুরো দিনটাই সুন্দর কাটে। তাই আমাদের উচিত হবে এমন অভ্যাস তৈরি করা, যা শরীর ও মনের জন্য দুটোরই উপকারে আসে। অতএব, কফি ভালো, তবে সীমার মধ্যে। আর বিকল্পের খোঁজে থাকলে প্রাকৃতিক পানীয়, হালকা ব্যায়াম এবং পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই বললেই চলে।

এম.কে.

×