
ছবি: প্রতীকী
মানুষের জীবনে লজ্জা একটি স্বাভাবিক অনুভূতি। এটি একদিকে যেমন নৈতিক বোধ এবং আত্মসম্মানবোধের পরিচায়ক, অন্যদিকে কখনো কখনো এটি মানুষকে পিছিয়েও দিতে পারে। বিশেষ করে যদি কেউ জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লজ্জাবোধে আক্রান্ত হন, তবে তা তার সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে।
বাস্তবতা হলো, এই লজ্জার আবরণ না সরাতে পারলে অনেক বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে এবং একসময় জীবনকে ছোট করে দেখার অভ্যাস তৈরি হয়। জীবনে বড় হতে চাইলে এমন তিনটি জায়গায় লজ্জা ভুলে গিয়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হয়। এই জায়গাগুলোতে লজ্জা পেলে আপনি নিজেকে আবদ্ধ করে রাখবেন এবং উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রথমত, শেখার ক্ষেত্রে লজ্জা করলে কখনোই বড় হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো, কেউ যদি কিছু না জানে বা ভুল করে, তবে তাকে হাসির পাত্র বানানো যায়। বিশেষ করে যারা বড় হয়েও মৌলিক কিছু জানেন না, তাদের নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়। ফলে অনেকে নতুন কিছু জানতে চাইলে লজ্জা পান, প্রশ্ন করতে সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু এই মানসিকতা একজন মানুষকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জীবনে বড় হতে হলে বারবার প্রশ্ন করতে হবে, ভুল করতে হবে, এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। একজন সফল ব্যক্তি কখনোই নিজেকে সবজান্তা মনে করেন না। বরং তারা শেখার জন্য যে কোনো বয়সে, যে কোনো জায়গায় প্রস্তুত থাকেন। স্কুল-কলেজ, অফিস কিংবা কোনো ট্রেনিং যেখানেই হোক না কেন, লজ্জা ভুলে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। অনেকেই আছেন, যারা ইংরেজি জানেন না বলে কথা বলতে ভয় পান, পাছে কেউ হাসে! কিন্তু আপনি যদি ভয় বা লজ্জা কাটিয়ে সেই ভাষায় কথা বলার চেষ্টা না করেন, তবে কখনোই দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞান অর্জনের পথে লজ্জা একটি প্রধান বাঁধা। এই বাঁধা অতিক্রম না করলে আত্মউন্নয়ন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, নিজের অধিকার ও প্রয়োজন জানাতে লজ্জা করলে আপনি সবসময় অবহেলিত থেকে যাবেন। জীবনে বড় হতে চাইলে নিজেকে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতে জানতে হবে। পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা বন্ধুদের মাঝে নিজের প্রয়োজন, নিজের সীমা ও চাওয়া-পাওয়া জানাতে না পারলে অন্যরা কখনোই তা বুঝবে না। কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যেই এই জড়তা কাজ করে— ‘বলে ফেললে যদি খারাপ লাগে’, ‘লোকে কি ভাববে’, ‘আমি চাইলে কি আমি স্বার্থপর হবো?’— এসব প্রশ্নে আমরা চুপ করে যাই। অথচ একজন সফল মানুষ কখনো তার প্রয়োজন নিয়ে সংকোচ করেন না। তিনি জানেন, নিজের প্রয়োজন বোঝানো মানে অহংকারী হওয়া নয়, বরং এটি আত্মমর্যাদার প্রকাশ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্মক্ষেত্রে অনেকেই আছেন, যারা কাজের চাপ সহ্য করেও অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে রাজি হন, কারণ তারা না বলতে ভয় পান বা লজ্জা পান। আবার অনেকে আছেন, যারা প্রাপ্য বেতন বা সুযোগ-সুবিধা চাইতে পারেন না। কারণ তারা ভাবেন, অন্যরা কি ভাববে? এই লজ্জা আপনাকে কখনোই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে না। বরং অন্যরা আপনার জায়গা দখল করে এগিয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে লজ্জা করলে আপনি কখনোই নিজের মতো করে জীবন গড়তে পারবেন না। আমাদের অনেকেরই ভেতরে অসংখ্য স্বপ্ন থাকে। কেউ গান শিখতে চায়, কেউ ব্যবসা করতে চায়, কেউ লেখালেখিতে ক্যারিয়ার গড়তে চায়। কিন্তু এক সময় সেই স্বপ্নগুলো থেমে যায়, কারণ আমরা ভাবি— “এই বয়সে শুরু করলে সবাই হাসবে”, “লোকজন বলবে, পাগল নাকি?”, “পরিবার কি মেনে নেবে?” এই ভয়-লজ্জা মিলেই আমাদের আটকে রাখে। জীবনে বড় হতে হলে এই সামাজিক লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে। ইতিহাসের প্রায় সব সফল মানুষই প্রথমে হাস্যকর ছিল, অবহেলিত ছিল, এমনকি নিজের পরিবার থেকেও উপহাসের শিকার হয়েছিল। কিন্তু তারা থেমে থাকেননি। তাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট, আর সেই লক্ষ্য পূরণে তারা লজ্জাকে পাত্তা দেননি।
এছাড়াও, যারা বড় হতে চান, তাদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, নিজেকে তুলে ধরতে হয়, নিজের কাজের প্রচার করতে হয়। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা নিজেদের গুণাবলি বা কাজ নিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতেই পারেন না। তারা ভাবেন, এতে অহংকার প্রকাশ পায়। অথচ এটি আত্মবিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। আপনি যদি নিজেই নিজের কাজের মূল্য না বোঝেন, তবে অন্য কেউ তা বুঝবে কেন?
সবশেষে, বলা যায়, লজ্জা তখনই প্রশংসনীয় যখন তা নৈতিক অবক্ষয় থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু যখন এই লজ্জা মানুষকে বাধা দেয় শেখার, বলার, করার, তখন সেটি আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। জীবনে বড় হতে চাইলে শেখার সময়, নিজের অধিকার দাবি করতে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে লজ্জা নামক শত্রুকে জয় করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সফলতার পথে একমাত্র আপনিই আপনার সঙ্গী। লজ্জা ভুলে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যান, কারণ ইতিহাস কখনো লাজুকদের কথা মনে রাখে না, ইতিহাস মনে রাখে সাহসীদের।
এম.কে.