ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রেমের বিয়ে বনাম অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ— কোনটা টেকে বেশি?

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৫ জুলাই ২০২৫

প্রেমের বিয়ে বনাম অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ— কোনটা টেকে বেশি?

ছ‌বি: প্রতীকী

বিয়ে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে দুটি মানুষ তাদের জীবনের দীর্ঘ পথচলায় একে অপরের সঙ্গী হয়। তবে এই বন্ধনের সূচনা কেমনভাবে হচ্ছে— প্রেমের মাধ্যমে নাকি পারিবারিকভাবে আয়োজিত তা নিয়ে সমাজে বহুদিন ধরেই বিতর্ক চলে আসছে।

প্রেমের বিয়ে বনাম অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা, মতামত ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উভয় ধরনের বিয়েরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। তবে কোন ধরণের বিয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা টেকে, সেটি নির্ভর করে অনেকগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিষয়ের ওপর।

আধুনিক বিশ্বে প্রেমের বিয়েকে অনেকেই স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দের প্রতিফলন হিসেবে দেখেন। সেখানে একজন মানুষ নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই বেছে নেন, একে অপরকে দীর্ঘ সময় ধরে চিনে ও বুঝে তারপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এইভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠলে ধারণা করা হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া ভালো হয়, রোমান্টিক সংযোগ দৃঢ় থাকে এবং মানসিক সামঞ্জস্য বেশি হয়।

কিন্তু গবেষণাগুলো বলছে, এই ধারণা সবসময় সত্যি নাও হতে পারে। প্রেমের বিয়েতে প্রথমদিকে রোমান্স, ভালোবাসা ও আবেগ তুঙ্গে থাকলেও, বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ যেমন আর্থিক সমস্যা, পারিবারিক দায়িত্ব, সন্তান লালন-পালন, কর্মজীবনের চাপ ইত্যাদি যখন সামনে আসে, তখন অনেক দম্পতি সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খায়।

অন্যদিকে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ বা পারিবারিকভাবে নির্ধারিত বিয়েতে প্রেমের জায়গা হয়তো শুরুতে কম থাকে, কিন্তু সামাজিক কাঠামো, পারিবারিক সহায়তা ও দায়িত্ববোধের কারণে এই ধরনের বিয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক সময় বেশি দেখা যায়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে যেসব দম্পতিরা বিয়ের শুরুতে একে অপরকে খুব একটা চেনেন না, তারা সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ধীরে ধীরে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জন্মায়।

একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা হলো যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট রবার্ট এপস্টাইনের একটি সমীক্ষা, যেখানে তিনি বলেন, প্রেমের বিয়েতে শুরুতে ভালোবাসার মাত্রা বেশি থাকলেও সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়, আর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে ঠিক উল্টোটা ঘটে— প্রথমে কম ভালোবাসা থাকলেও সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের প্রচলন বেশি। এই সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধ, সামাজিক সম্মান ও ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে অনেকেই প্রেমের বিয়েকে সন্দেহের চোখে দেখে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই ধারণার কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নগরায়ন, উচ্চশিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে তরুণ-তরুণীরা বেশি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ফলে প্রেমের বিয়ের হার বাড়ছে। তবুও, দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো অ্যারেঞ্জড ম্যারেজই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বলে পরিসংখ্যান বলছে।

প্রেমের বিয়েতে দম্পতিরা আগে থেকেই একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ, অভ্যাস, চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অবগত থাকে। তবে অনেক সময় দেখা যায়, একে অপরের প্রতি অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা রোমান্টিক ভাবনার সঙ্গে বাস্তব জীবনের ব্যবধান সম্পর্ককে দুর্বল করে তোলে। একই সঙ্গে, পরিবারের পূর্ণ সমর্থন না থাকলে সম্পর্কটি সামাজিক চাপের মুখে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়।

অপরপক্ষে, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে শুরুতে যেহেতু পরিবার ও আত্মীয়দের সক্রিয় ভূমিকা থাকে, তাই সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানে পারিবারিক সহায়তা পাওয়া যায়, যা অনেক সময় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হয়।

বিভিন্ন দেশের বিবাহ-বিচ্ছেদ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানেও এই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমের বিয়ের হার বেশি, এবং সেইসঙ্গে ডিভোর্স রেটও তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে, যেখানে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের প্রচলন বেশি, সেখানকার ডিভোর্স রেট তুলনামূলকভাবে কম। অবশ্যই এটি বলতে হবে, সব সময় ডিভোর্স রেট কম মানেই সম্পর্ক ভালো ছিল এমন নয়— অনেক সময় সামাজিক বা পারিবারিক চাপের কারণে মানুষ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্পর্ক টেকাতে হলে ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার পাশাপাশি দরকার সম্মান, ধৈর্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা। প্রেমের বিয়ে হোক বা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ কোনোটিই নিখুঁত নয়। উভয় ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ থাকে, এবং টিকে থাকার জন্য দরকার দু’জনের আন্তরিক চেষ্টা ও মানসিক পরিপক্বতা।

গবেষণাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এও বোঝা যায়, প্রেমের বিয়ে হোক কিংবা অ্যারেঞ্জড, সফল দাম্পত্য জীবনের চাবিকাঠি হলো কমিউনিকেশন, বাস্তববাদিতা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি।

অতএব, প্রেমের না অ্যারেঞ্জড— কোন বিয়ে বেশি টেকে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। এটি নির্ভর করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট, দম্পতির মানসিকতা এবং তাদের সম্পর্কের গুণগত মানের ওপর। প্রেমের বিয়েতে যেমন শুরুতেই আবেগ থাকে, তেমনি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে থাকে পারিবারিক দৃঢ়তা ও বাস্তবধর্মী সম্পর্কের ভিত্তি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— যে ধরনের বিয়েই হোক না কেন, তাতে যদি দু’জন মানুষ একে অপরকে সম্মান করে, বিশ্বাস করে এবং একসঙ্গে পথ চলার মানসিক প্রস্তুতি রাখে, তবে সেটিই বেশি টেকে।

এম.কে.

×