
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে ১ নম্বর অগ্রাধিকারে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সাজাচ্ছে সরকার। বাজেটে সুযোগ তৈরি করা হবে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের। এজন্য উজ্জীবিত করা হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো খাতের কর্মযজ্ঞকে। বড় তেমন কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। করা হবে না ঢাউস আকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি)। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় ভাতা কিছুটা বাড়ানো হবে। বাড়ানো হবে ভাতাভোগীর সংখ্যা। সবই করা হবে সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট তৈরির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্র্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট। আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। টেলিভিশনের পর্দায় অর্থ উপদেষ্টা বাজেট ঘোষণা করবেন ২ জুন।
রাজস্ব সংগ্রহের বড় কোনো উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় আগামী বাজেট তেমন বড় করা হচ্ছে না। এ কারণেই চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা। অহেতুক উচ্চাভিলাষী নয়; বরং একটি বাস্তবভিত্তিক বাজেটের দিকেই এগোচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯ দশশিক ১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। সরকার প্রথমে আগামী অর্থবছর শেষে এ হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে ঠিক করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় এ হার আরও কমবে বলে সরকার আত্মবিশ্বাসী।
বাজেট মোটামুটি চূড়ান্ত করার জন্য সচিবালয়ে সম্প্রতি অনলাইনে আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হতে পারে বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন জাতীয় সংসদে। সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
মূল্যস্ফীতি (নিয়ন্ত্রণকে) প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করতে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। এ ছাড়া নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বাজেটে। মানুষের জীবনযাত্রা যেন সহজ হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে বলে জানা যায়। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হবে। আগামী অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কিছুটা কমিয়ে ইতোমধ্যে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকবে। এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন থাকবে বাজেটে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ টাকা। কিন্তু আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ২১ শতাংশ। রাজস্ব আয় চার লাখ কোটি টাকা করতেই ঘাম ছুটে যায়। সে বিবেচনায় আগামী বাজেটও উচ্চাভিলাষী হবে। এতে ঘাটতি বড় হবে। এটা কোনোভাবেই ছোট বাজেট হবে না, মূল্যস্ফীতি কমার বাজেটও হবে না, এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ার বাজেটও হবে না। সাত হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা মানে হচ্ছে, কল্পনার সঙ্গে কল্পনার তুলনা করা। অনেকটা এ রকম আগের সরকার চাঁদে যাওয়ার কথা বলেছিল, এখন বলা হবে মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার কথা। আগের সরকার যে বাজেট ঘোষণা করত, তার অনেকটাই অবাস্তবায়িত থাকত। বর্তমান সরকার সেই ঘোষিত বাজেটের চেয়ে মোট ব্যয় সাত হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলছে।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প বাদ দেওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি কমছে। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ও বিনিয়োগে মন্দার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শ্রমিক অসন্তোষের মুখে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে রাজস্ব আহরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমছে। এসব সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরের শুরুতে (জুলাই) ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে জুনের মধ্যে সংশোধিত বাজেটের আকার অনুযায়ী অবশিষ্ট চার লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে।
এদিকে অর্থ ব্যয় না হওয়ার শঙ্কায় চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেট থেকে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এতে সংশোধিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বছরের শেষ সময়ে একসঙ্গে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি অপচয়, দুর্নীতি ও গুণগত মান নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকে। অর্থ বিভাগ এ শঙ্কার কথা জানিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শেষ সময়ে মন্ত্রণালয়গুলোর অস্বাভাবিক খরচের কারণে সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এছাড়া রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়-এ দুয়ের মধ্যে কোনো পরিকল্পনা থাকছে না। এতে অপরিকল্পিত ঋণ গ্রহণ এবং ঋণসংক্রান্ত ব্যয়ের দায়ভার বহন করতে হয় সরকারকে, যা আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিচ্ছে।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব বিল যাচাই-বাছাই করে দিচ্ছে। যে কারণে ব্যয় কম হচ্ছে। তবে কোনো বছরই বাজেটের পুরো অর্থ ব্যয় হয় না। শেষ সময়ে একসঙ্গে তাড়াহুড়া করে টাকা ব্যয় করতে গিয়ে অপচয়, দুর্নীতি ও অর্থব্যয়ের গুণগতমান নষ্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে উন্নয়ন কাজের বিল যাচাই-বাছাই করে দেওয়া ভালো হবে। বাজেট কাটছাঁট প্রসঙ্গে অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প যেগুলো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নেওয়া সেগুলো বাদ দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে কিছু টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন কম হওয়ার পেছনে কয়েকটি সংকট শনাক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে সামগ্রিকভাবে অর্থ সংকট বাস্তবায়নে বড় সমস্যা। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণ চলতি অর্থবছরে বেড়েছে। এই অর্থ ছাড় ও এর ব্যবহার করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে অর্থায়ন নিয়ে ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব রয়েছে। আগের সরকার রাজনৈতিকভাবে অনেক প্রকল্প নিয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকার এসে এ ধরনের প্রকল্প বাদ দিয়েছে। এ ছাড়া অর্থবছরের শুরুতে চলে আসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, যা গত ৮ মাস ধরে অব্যাহত আছে। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটি বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ভারসাম্যে সংকট এবং বিনিয়োগ কমে আসায় এ বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা লেগেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রাজস্ব আহরণ, মোট ব্যয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন ও পরিচালন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও জুলাইয়ে আন্দোলনে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে। দেশের বন্দরগুলো অকার্যকর হয়ে পড়লে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাহত হয়। সারাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে (এডিপি) নেমে আসে স্থবিরতা। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি এই ৮ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ ৬ হাজার ২ কোটি টাকা। সেখানে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণে বাজেট বাস্তবায়নে প্রথম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অর্থায়নের সমস্যা।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়ার পরও অনেক মন্ত্রণালয়ের ব্যয় করার সক্ষমতা থাকছে না। এটি একটি সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে অর্থ ব্যয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই, বছরের শুরুতে বেতন-ভাতা, ইউটিলিটি বিল ছাড়া অন্য কোনো ব্যয় তেমন করা হয় না। কিন্তু শেষ দিকে আবার অস্বাভাবিকভাবে টাকা খরচ হয়। বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অদক্ষতা তো আছেই। আছে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি পিডি হিসেবে নিয়োগ না পাওয়া ও জমি অধিগ্রহণে জটিলতা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আলোচনায় আসে না, সেটি হচ্ছে অননুমোদিত প্রকল্প। অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকাও কম বড় নয়। তদবিরের তোড়ে এগুলো অনুমোদিত হয় এবং বছরের মাঝামাঝি সময়ে থোক বরাদ্দ থেকে অর্থ স্থানান্তর করে এগুলোর নামে দেওয়া হয়। এই করতে করতে অর্থবছর শেষ হয়ে যায়, কিন্তু খরচ আর হয় না। বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে এসব সমস্যাও দূর করা দরকার।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল