ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইতিহাসে ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া (আ.)

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ১ আগস্ট ২০২৪

ইতিহাসে ফেরাউনের স্ত্রী হজরত আছিয়া (আ.)

প্রসঙ্গ ইসলাম

পৃথিবীর নারীকূলের মধ্যে স্বামীভক্তির জন্য মুসলিম ইতিহাসের পাতায় হজরত আছিয়া (আ.) এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে রয়েছেন। তাঁর কীর্তি, সুমহান ত্যাগ ও আদর্শ এবং ইমানী দৃঢতা প্রকৃতপক্ষেই এক বিস্ময়কর বিষয়। লা-শরীক আল্লাহর তাওহীদ রক্ষার্থে তিনি অপরিসীম দুঃখ জ্বালা, যন্ত্রণা, অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করে নিজের বিশ্বাসকে মিথ্যার সংস্পর্শ থেকে সযত্নে রক্ষা করে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ বিশ্বাসী হিসেবে অমর নিদর্শন স্থাপন করেছেন। হজরত ঈসা (আ.) এর জন্মের ১৩৬৩ বছর পূর্বে আব্বাস শহরে বনি ইসরাইল বংশে হজরত আছিয়া (আ.)-এর জন্ম।

তাঁর পিতার নাম মোজাহাম। তিনি ছিলেন বনি ইসরাইল বংশের একজন সম্ভ্রান্ত ও ধনী, বিদ্বান অতিশয় ধর্মপরায়ণ পুণ্যবান ব্যক্তি। পুণ্যবতী আছিয়া (আ.) এর পিতা মোজাহামকে সবাই অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করত। কারণ, তিনি ছিলেন নবী হজরত ইয়াকুব (আ.) এর পুত্র লেবিয়ার বংশধর। শিশুকাল থেকেই পিতা কন্যার ধর্মপরায়ণতার পরিচয় পেয়ে সযতেœ বিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। সুদক্ষ ও জ্ঞানী ওস্তাদ রেখে তিনি কন্যাকে ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করালেন এবং অতি অল্প বয়সেই হজরত আছিয়া (আ.) সর্বপ্রকার দ্বীনি কাজে পারদর্শিনী হয়ে উঠলেন এবং সে আদর্শেই নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে লাগলেন। 
এখানে আর একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, হজরত আছিয়াকে (আ.) মিসরীয়রা নেফারতিতি নামেই চিনে এবং এই নামেই তাঁর সমাধিতে ফলক লাগানো রয়েছে। আমরা এখানে হজরত আছিয়াকে  নেফারতিতি নামেই সম্বোধন করছি। নির্দিষ্ট একটা বয়সে এসে নেফারতিতির ধর্মপরায়ণতা, রূপ ও গুণের সংবাদ দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তখনকার দিনে মিসরের আদি অধিবাসী কিবতীগন যেমন ছিল অজ্ঞ তেমনি ছিল হিংসুটে এবং অত্যাচারী।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বলে তারা বনি ইসরাইল জাতিকে কখনও ভালো চোখে দেখত না। বনি ইসরাইল জাতির ওপরে অত্যাচার-অবিচার চালাত। তৎকালীন মিসরীয় বাদশাহদের উপাধি ছিল ফারাঁও বা ফিরাউন। আদিবাসী বলে কিবতীগন বাড়তি সুবিধা পেত এবং ফিরাউনের দরবারের সবচেয়ে বড় পদগুলো পাওয়ার সুবিধা লাভ করত। এ অহংকারের বশবর্তী হয়েই বনি ইসরাইলদের নিতান্ত হেয় এবং ঘৃণ্য বলে ধারণা করত। সামাজিক মান-মর্যাদা বনি ইসরাইলদের কিবতীদের তুলনায় প্রায় কিছুই ছিল না। আর সে কিবতী সম্প্রদায়ের জনৈক ধনী কৃষকের পুত্র ছিল কাবুস ওরফে দ্বিতীয় রামসিস।

সাধারণ ইতিহাসে যাকে রামসিস দ্য সেকেন্ড বা গ্রেট রামসিস নামে অত্যধিক চেনে। কাবুস নেফারতিতির রূপ-গুণের কথা শুনে তার পাণিপ্রার্থী হলো। মোজাহাম নিজে বনি ইসরাইল বংশের লোক ছিলেন। তা সত্ত্বেও কিবতী বংশের যুবক কাবুসকে দেখে স্বীয় কন্যার উপযুক্ত সুপাত্র বলেই ধারণা করলেন। কিবতী সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপন করার জন্যই নেফারতিতিকে কাবুসের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে উক্ত কাবুসই স্বীয় প্রখর বুদ্ধির কারণে মিসরের বাদশাহ ফিরাউনের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল।

সুতরাং পুণ্যবতী নেফারতিতির জীবন কাহিনী বর্ণনা করতে হলে পাপাত্মা ফিরাউনের কাহিনীই বর্ণনা করতে হয়। ফিরাউনের লোমহর্ষক জুলুম ও নিগ্রহই নেফারতিতির জীবনের মহিমা শতগুণে বিকশিত করার পথ সুগম করেছিল। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন:  ফেরাউন-পতœী বলল : হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে জালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন। - সুরা তাহরীম, আয়াত ১১।
মুসলিম নারীদের জন্য চিরবরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আছিয়া। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা সুউচ্চ প্রাসাদের আলীশান মহলে তিনি বসবাস করতেন। সবুজ বৃক্ষের তলদেশে প্রাসাদের গা ঘেঁষে নীল দরিয়ার স্বচ্ছ পানি বয়ে চলত অবিরাম। এমন সব নেয়ামত ও আয়েশের মাঝেও আছিয়া ছিলেন অতৃপ্ত, অস্থির। তাহলে কোন্ সে পিপাসায় তিনি কাতর ছিলেন? কিসের অভাবে ছটফট করতেন তিনি?

আল্লাহ পাকের কাছে আছিয়া কাতর দোয়া করেছিলেন তিনি যেন তাঁর স্বামীর দুষ্কর্ম থেকে তাকে হেফাজত করেন। তার জুলুমবাজ কওমের হাত থেকে রেহাই দেন তাকে। তিনি আরও বলেছিলেন, তাঁর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে পাপের রাজ্য কায়েম হয়েছে, সেখান থেকে বের হতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। অথচ এক সময় তিনি স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হৃদয়জুড়ে ছিল তাঁর ভালোবাসা। 
ফেরাউন তার সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ, সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে অপ্রতিদ্বন্ধী বাদশাহ ছিল। সে নির্বিচারে প্রজাসাধারণের ওপর সে জুলুম করত। বনী ইসরাঈল ছিল তার অবৈধ অত্যাচারের নিশানা। একদিন রাজ দরবারের প্রধান জ্যোতিষী ফেরাউনের কাছে এসে বলল, অচিরেই বনী ইসরাঈলের মাঝে একজন সন্তান জম্ম নিবে। তাঁর হাতে আপনার সা¤্রাজ্যের পতন অনিবার্য। জ্যোতিষীর এ সংবাদ বনী ইসরাঈলের ওপর ফেরাউনের পাষ-তা উথলে উঠল।

জ্যোতিষীর এ অসহনীয় কথায় তার উন্মত্ততা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। নিজেকে একটু প্রবোধ দেওয়ার জন্য, মনটাকে একটু সুস্থির করার জন্য বনী ইসরাঈলের ওপর জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের ধীরে ধীরে নৃশংসভাবে হত্যা করতে লাগল। তবে শুধু কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। অবশেষে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলের ভাগ্য লিখনে পরিবর্তন আনলেন। তাদের পর্যাপ্ত শক্তি ও ক্ষমতা দান করলেন। ফলে, ফেরাউন যে বিভীষিকার আশঙ্কা করত, তা স্বচক্ষে দেখতে বাধ্য হয়।
ফেরাউনের রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে ছোট্ট এক ঝুঁপড়িতে ইউহানিব না¤œী এক মহিলা বাস করতেন। তাঁর ঘরে একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। ফেরাউনের হিংস্র হাত থেকে বাঁচতে একাধারে তিন মাস গৃহাভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকলেন তিনি। এ জন্য ইউহানিব প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতেন। নিজের প্রতি নয়, ছেলে মুসার প্রতি ভয় ও ভালোবাসায় তিনি গভীর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে আল্লাহ পাক তাঁর সহায় ছিলেন।

তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন, এ শিশুটির জন্য একটি কাঠের সিন্দুক তৈরি কর। তারপর তাঁকে সিন্দুকের ভেতর ভরে নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও। আর তোমার মেয়েকে সিন্দুকের অনুসরণ করে নীল নদের পার দিয়ে চক্কর দিতে বলো। এ ঐশী আদেশ পেয়ে মুসা জননীর চিত্ত প্রশান্ত হলো। মন থেকে সব ডরভয় মুছে গিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। সুন্দর একটি সিন্দুক বানানো হলো। ইউহানিব নয়নের মণি মুসাকে সেখানে রেখে দিয়ে মেয়েকে বললেন, সিন্দুকটি মাথায় করে নীল নদের ঘাটে নিয়ে যাও। চতুর মেয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করল।

ইউহানিব সন্তান সমেত সিন্দুকটি নীল নদে ভাসিয়ে দিলেন। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে সিন্দুকটি ফেরাউনের মর্মর নির্মিত সুদৃশ্য সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল। প্রাসাদের এক খিড়কি দিয়ে আছিয়া এ সিন্দুকটি দেখতে পেলেন। বাচ্চাসহ সিন্দুকটি উপরে তুলে আনা হলো। আশপাশের লোকেরা শিশুটিকে হত্যা করতে ফেরাউনকে নানাভাবে উত্তেজিত করতে লাগল। কেউ একজন বলেও ফেলল, মহারাজ! সিন্দুকে বাচ্চা রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া আসলে আপনার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী হতে পারে এই বাচ্চাটিই আপনার রাজ্য পতনের কারণ হবে।

তাদের এই কথোপকথনের মাঝে আছিয়া এক কদম সামনে এসে বললেন, এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোনো খবর ছিল না। - সুরা কাসাস, আয়াত ৯।
আছিয়া স্বামীর কাছে এ শিশুটির বিষয়ে তার সাধারণ হুকুম বলবৎ না করার জন্য উপর্যুপরি অনুরোধ করতে থাকেন। প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বললেন, হতে পারে এ শিশু বড় হয়ে আমার একান্ত বাধ্যগত হবে আর আমরা তাঁকে আমাদের সন্তানরূপে গ্রহণ করব। এক পর্যায়ে ফেরাউন তার কথা মেনে নিল। রাজপ্রাসাদে মুসা তখন ফেরাউনের পুত্রবৎ হয়ে গেল। মানব সন্তানের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় আছিয়ার দিল টইটম্বুর। আনন্দের দোলায় তিনি দুলতে লাগলেন।
প্রাসাদের লোকেরা এ শিশুর জন্য একজন ধাত্রী খুঁজতে লাগল। চতুর্দিক থেকে ধাত্রীদের আগমনে প্রাসাদ ভরে উঠল। কিন্তু রাজাপ্রাসাদে আগত কোনো মহিলার স্তনই মুখে নিচ্ছে না বাচ্চাটি। ইত্যবসরে মুসার সহোদরা বোন সামনে এগিয়ে এসে বলল, আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি তোমাদের, আশা করা যায় এ বাচ্চা তাঁর দুধ পান করবে। আছিয়া বললেন, জলদি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আস।

মুসার বোন মারিয়াম দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, আম্মা! মুসা আগত কোনো মহিলার দুধই পান করছে না। সকলেই হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। আমি তাদের আপনার কথা বলে এসেছি। চলুন। ইউহানিব বলতে লাগলেন, আমার প্রচ- ভয় হচ্ছে, যদি তারা কোনোভাবে বুঝে ফেলে যে আমি তাঁর মা, তাহলে কী হবে? (চলবে)।

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×