ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

আবার এসেছে আষাঢ়

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১৯ জুন ২০২৪

আবার এসেছে আষাঢ়

বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো নেমে

ভারি বর্ষণ মানেই বন্যার পানির অবিমিশ্রধারা। যাতে সংশ্লিষ্ট উপদ্রুত অঞ্চলবাসী হরেক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করে। নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অতি সাধারণ জনগোষ্ঠীর বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার দৃশ্য সত্যিই এক চরম দুর্ভোগ। আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না। সময়ে সবচেয়ে জরুরি হয়ে যায় আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া অসহায় মানুষদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ। সেটাও দুর্যোগপরবর্তী এক প্রাসঙ্গিক কর্মযোগ। কতজনের বসতভিটা যে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, সেটারও কোনো হিসাব নিকাশ থাকে না

‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো নেমে’-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষা বন্দনার চিরায়ত বচন শৌর্য। সুরের মূর্ছনায় তেমন শৈল্পিক অনুরণন শ্রোতাদের বর্ষার নবরূপ, রসে যেন উদ্বেলিত করে। আর আষাঢ়ের পদধ্বনি জানান দিচ্ছে তার শুভাগমনের অনন্য বার্তা। ঘন ঘোর বরিষায় কালো মেঘের নিবিড় ছায়ায় প্রকৃতি যেন উত্তাল, উন্মুখ জল সিঞ্চিত করার অপার সমারোহে। মেঘ গর্জনের অবিরাম বিকট শব্দে নৈসর্গ যেন এক তা-বে মেতে ওঠে। সেখানে যেমন ঝড়ো হাওয়া, ঝিরঝির বৃষ্টির ধারা তার সঙ্গে পুরো প্রকৃতি পরিবেশে ভালো লাগার নির্মল অনুভূতিতে মগ্ন। কোলের সন্তান হয় আবেগে আপ্লুত, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে অনন্য উন্মাদনায়।

আষাঢ়ের নতুন প্রহর তার আগমন বার্তা জানান দিতে মোটেও কসুর করছে না। ইতোমধ্যে বৃষ্টিস্নাত আবহ প্রকৃতিতে ভর করেছে। নিসর্গও ব্যাকুল নব আনন্দে দিশেহারা হতে। আবহমান বাংলায় বর্ষা আসে তার সর্ববিধ আবেদন আর আয়োজনে ভরপুর হয়ে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত ও নদীস্নাত বাংলার রূপ-রসের আরেক আধার বর্ষা মঙ্গলের জয়ধ্বনি। ষড়ঋতুর বিচিত্র এই দেশে শস্য-শ্যামল সবুজ প্রান্তরের স্বয়ম্ভরতা সেই আদিকাল থেকে সংশ্লিষ্ট জনগণকে ধনে, ধানে, পুষ্পে ভরিয়ে রেখেছে। কৃষিনির্ভর বাংলা আজও তার সামগ্রিক পরিম-লে চিরায়ত ঐশ্বর্যকে জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর কবি-সাহিত্যিকদের জন্য অভাবিত এক মাহেন্দ্রক্ষণ তো বটেই।

ঝিরঝির বৃষ্টির দোলায় সৃজন ক্ষমতাও যে অনুরণিত হয় সেটা জানা-বোঝার পরম বিস্ময়। তবে এমন সুষমাম-িত বাংলার পলিমাটির সবুজায়নে বিপরীত ¯্রােতও হানা দেয় তার বিকট বৈপরীত্যে। সেখানে চিরায়ত বর্ষার প্রাচীন রূপ শৌর্য কেমন ছিল তাও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সেখানেও আছে ভরা বর্ষায় সেই আদিকাল থেকেই সৃজন বোদ্ধাদের আলোড়িত করার পরম কাব্যবিন্যাস। এমন সৃষ্টিশীল দ্যোতনা যেন বরেন্দ্র এই অঞ্চলের এক অক্ষয় ঐশ্বর্য। আবার ভিন্নমাত্রায় ভাঙনের খেলায় মেতে উঠতেও তেমন সময় লাগে না।

সেই পুরাকালের মহাকবি কালিদাস আকাশের মেঘ থেকে প্রিয় মানুষের জন্য আবেগ উচ্ছ্বাসে নিবেদিত হওয়ার কথা সকলেই জানা। আদি মহাকবি কালিদাস তার আকাক্সিক্ষত প্রিয়ার কাছে মেঘকেই দূত করে পাঠান অন্তর নিঃসৃত ভালোবাসার অপার মহিমায়। আর এক কবি বিদ্যাপতি? তিনিও ভরা বর্ষায় আকুল আবেদন আর সমর্পণে ব্যাকুল হন। নীরবে নিভৃতে কাব্য ঝঙ্কারে অনুভব করলেনÑ সখি এই ভরা বাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।
অর্থাৎ বেদনাবিধুরে বিরহের আকুল আবেদন তো বটেই। কালিদাস আর বিদ্যাপতির প্রাচীন আর মধ্যযুগের যে আনন্দ বিলাস, তেমন বর্ষা কবিগুরুকে আরও বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনায় পূর্ণ থেকে পূর্ণতর করে দেয়। সঙ্গত কারণে বিভিন্ন গবেষক, বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ ‘বাংলার বর্ষা নাকি রবীন্দ্রনাথেরই আবিষ্কার’। তবে কবির সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা এমন পরিচয় তার সাহিত্যের যত্রতত্র। বর্ষা বন্দনা আর মঙ্গলে রবীন্দ্রনাথের সমর্পণ নিবেদন শুধু যে তার সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে অতিক্রম করে তাই নয়। বরং বাংলা সাহিত্যেও তার দাম অতুলনীয়। যার নজির তিনি নিজেই।

বিজ্ঞজনদের ধারণা মতে, যে বাংলার বর্ষা কবির হাতেই নবরূপে অনন্য সৃষ্টিতে এগিয়ে যায়, তা আনন্দ প্রাচুর্যের ভিন্ন মাত্রা তো বটেই। বর্ষায় মিলেমিশে একাকার হয়েছে ঈশ্বর, প্রকৃতি আর প্রেম। বর্ষার অবিরাম ধারায় নিজেকে প্রকাশের যে আকুলতা, তেমন সুসময়ে কত কথা যে ভেতরের বোধে জিইয়ে থাকে, সেটাও পাঠকদের বিচলিত করে। ব্যথিত অনুভবের নিবেদনÑ যে কথা এ জীবনে, রহিয়া গেলো মনে, সে কথা আজ বুঝি বলা যায়,/ এমন ঘন ঘোর বরিষায়।
বলা যায় কি না ভাবা মুশকিল। কবি নিজেই হয়তো বর্ষণসিক্ত কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে নিজের অজান্তেই অন্তর্নিহিত বোধকে সৃষ্টির আবেগে অনুরণিত করে।

তেমন আষাঢ় মাসের শুভ পদচারণায় পরিবেশ-পরিস্থিতি যে মাত্রায় সিক্ত থেকে আরও তীব্র হয়, সেখানে মনের মাধুরী মেশানো অব্যক্ত সুখই শুধু নয়, ব্যথা-বেদনার স্মৃতিকাতরতাও বিষাদঘন অনুভব। অনুকূল প্রাসঙ্গিক পরিবেশের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ ধনে ধান্যে, ফল ফুলে সুশোভিত আবহমান বাংলা। শস্যখেতে বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত পানি যেভাবে উৎপাদনের সহায়ক উজ্জীবিত শক্তি, তা বলার অপেক্ষায় থাকে না। আবার অতি বৃষ্টিতে বন্যার প্লাবনে প্রায় ভেসে যাওয়াও বর্ষার বিপরীত স্রোতধারা। বর্তমানে চা শিল্প নগরী সিলেট বৃষ্টি আর পানিতে ডুবন্ত অবস্থায়।

আষাঢ়ের আগেই সিলেটে যে বন্যার কালো থাবা সেখান থেকে উত্তরণের আগেই আষাঢ়ের জলসিঞ্চন যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ভাবাই যাচ্ছে না মাঙ্গলিক বর্ষা যেন অভিশাপের ডালা নিয়েই সংশ্লিষ্টদের যাপিত জীবন দিশেহারা করে দিচ্ছে। তাই বর্ষা যেমন সৃষ্টি সম্ভারের অনবদ্য দ্যোতনা, পাশাপাশি ভাঙনেরও চরম পাশর্^প্রতিক্রিয়া। যা জনগোষ্ঠী তার যাপিত জীবনকে দিয়ে যে মাত্রায় অনুভব করে, সেটা কম উপদ্রবের নয়। সিলেটের অকাল বন্যার ঝুঁকি না কমতেই আবারও বৃষ্টির ধারা বর্ষণ সংশ্লিষ্ট জেলা আর মানুষদের যে দুর্ভোগ, তাও ঋতুবৈচিত্র্যের চরম দুর্বিপাক। আবার কোরবানির ঈদ উৎসবও ভরা বর্ষায় কতখানি নাজেহাল করা থেকে বিরত ছিল, তাও সময়ের অশনি সংকেত। 
ইতোমধ্যে বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে সবুজ প্রবৃদ্ধির কাঠামো বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের অনুগামী। শ্যামল বাংলা বরাবরই উৎপাদনশীলতার এক অনন্য পীঠস্থান। নরম পলিমাটির উর্বর চারণ ভূমিতে অতি সহজেই শস্য ফলানোর যে অবারিত সুযোগ, সেটাই বিশে^র সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশের অনন্য এক সম্পদ। ক্লান্তিহীন বর্ষণ আর পানিতে শুধু ভাসমান থাকা নয়, বরং যাপিত জীবনের হরেক বিপর্যয়ও মাথাচাড়া দেয়। আষাঢ় মাসের অনন্য ক্ষণে বৃষ্টি ধারা কাম্য এবং বাঞ্ছিত হলেও মাত্রাতিরিক্ত সবই হিতের পরিবর্তে বিপরীত আবহে যেন অনাকাক্সিক্ষত এক বিরূপ প্রকৃতিই বলা যায়। শুরুতেই বৃষ্টির আলামত।

তার মধ্যেই পালিত হয়েছে পবিত্র কোরবানির ঈদ। অসময়ের বিপত্তিতে ঈদ উৎসবও নাজেহাল অবস্থায় অনেক স্থানে। অসহনীয় প্রকৃতি বিরূপতায় ভাঙাগড়ার যে অসম লড়াই, সেটা সামলে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াও এক অবধারিত কর্মযাতনা। নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। উষ্ণভাবাপন্ন প্রতিবেশে ষড়ঋতু তার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে যেন ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। আগের মতো বর্ষাকাল আর বৃষ্টির ধারায় সিক্ত হয় না। আবার অকাল বর্ষণও যেন প্রকৃতিকে মাতিয়ে দেয়। সেটা ১৭৬০ সালে ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পরপরই।

তবে সেটা অনুধাবন করতেও বিশ^বাসীকে পুরো একটা শতক অপেক্ষা করতে হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষলগ্নে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ তুললেন- ধরিত্রীকে সুরক্ষা দিতে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সেখানে আসা জরুরি প্রকৃতি সহায়ক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। উন্নত শিল্প ব্যবস্থাপনায় যে মাত্রায় ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ হয়, তা প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে দূরবর্তী করে দেয়। সবচেয়ে দুঃসহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায় আর প্রকৃতি হয়ে পড়ে উষ্ণতার এক দাবদাহে।

যেখানে হরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলবাসীকে যে মাত্রায় দিশেহারা করে দেয়, তাও আধুনিক শিল্প-সভ্যতার নেতিবাচক প্রভাব প্রতিপত্তি। আমরাও বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করি ষড়ঋতুর অনবদ্য সম্ভারে চিরস্থায়ী যে রূপশৌর্য শাশ^ত বঙ্গভূমির, সেখানে আজ চরম দীনতা আর নিদারুণ দাবদাহের অসহনীয় প্রতিকূল পরিবেশ। এখান থেকে বের হতে না পারলে আগামীর প্রজন্ম বাংলার চিরস্থায়ী রূপ-রস সম্পর্কেই অজানা-অচেনা এক প্রতিবেশকে মোকাবিলা করবে।

তেমন নিদারুণ চিহ্ন শুরু হয়ে গেছে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের আরও আগে। তবে শুরুটা করি আষাঢ় মাসের অনন্য বৃষ্টিস্নাত রূপের চিরস্থায়ী আধারকে নিয়েই। মাত্র শুরু হওয়া আষাঢ় পুরো বর্ষাকালকে কোথায় নিয়ে যাবে কিংবা কোন্ মাত্রায় থামবে, তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনা। 
ভারি বর্ষণ মানেই বন্যার পানির অবিমিশ্রধারা। যাতে সংশ্লিষ্ট উপদ্রুত অঞ্চলবাসী হরেক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করে। নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অতি সাধারণ জনগোষ্ঠীর বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার দৃশ্য সত্যিই এক চরম দুর্ভোগ। আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না। সময়ে সবচেয়ে জরুরি হয়ে যায় আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া অসহায় মানুষদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ। সেটাও দুর্যোগপরবর্তী এক প্রাসঙ্গিক কর্মযোগ। কতজনের বসতভিটা যে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, সেটারও কোনো হিসাব নিকাশ থাকে না। মানবিক আর সহনশীল দায়বদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ানোই এক অবশ্যম্ভাবী কর্মযজ্ঞ।

সিলেট তো বটেই, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলও বৃষ্টির অবিরাম ধারা আর বন্যার পানিতে এক অসহনীয় জীবন অতিক্রম করছে। প্রকৃতির সঙ্গে শুধু সখ্য নয়, বরং বিপরীত প্রবাহকে সামলাতেও যে দুর্বিষহ চরম অবস্থা, সেটাও নদীবিধৌত বাংলার নিতান্ত দুর্ভোগ। ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্র্যে আবহমান বাংলার যে নিত্যনতুন রূপের ভিন্ন মাত্রার জীবনযাপন তাও এই অঞ্চলের নানামাত্রিক প্রতিবেশ পরিস্থিতি। লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় সমুদ্র আর নদী পরিবেষ্টিত এই শাশ^ত শ্যামল বাংলায়। যার রূপ-রসে বিমুগ্ধ স্বদেশী সৃজনবোদ্ধা আর ভিনদেশী পরিব্রাজক।

তেমন সুশোভিত শ্যামল বাংলা আগের অবস্থানে খুঁজে পাওয়াও প্রাকৃতিক বিড়ম্বতা। সে সব মোকাবিলা করে শস্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর আবহমান বাংলার জনগোষ্ঠী টিকে থাকে। আজও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। হিসাবও মেলানো কঠিন। কত প্রান্তিক মানুষের ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে যায়, তেমন লাভ-লোকসান হিসাবের মধ্যেই আসে না। 

লেখক : সাংবাদিক

×