ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

লন্ডন মেয়র নির্বাচন ও একজন সাদিক খান

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশিত: ২১:৩০, ১২ মে ২০২৪

লন্ডন মেয়র নির্বাচন ও একজন সাদিক খান

.

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেনতিনি একজন সুযোগবঞ্চিত পরিবারের ছেলেসাদিক খান তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের একজনপাকিস্তান থেকে আসা সাদিক খানের বাবা ছিলেন বাস ড্রাইভার এবং মা জীবিকা নির্বাহের জন্য সেলাইয়ের কাজ করতেনতারা থাকতেন দক্ষিণ লন্ডনের একটি এলাকায় দরিদ্রদের জন্য তৈরি সরকারি কাউন্সিল ফ্ল্যাটেছোটবেলা থেকেই সাদিক খান নিজে যে আদর্শে বিশ্বাসী তা নিয়ে লড়তে এবং সাফল্যের জন্য সব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে পিছপা হননিআর সেই আত্মবিশ্বাস ও জেদ তাকে যুক্তরাজ্যের অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ এনে দিয়েছেলন্ডনের মেয়র হিসেবে যে ক্ষমতার অধিকারী তিনি হচ্ছেন আগামী চার বছরের জন্য, তা-তার জন্য বিরাট একটা আবেগের বিষয় বলে তিনি মন্তব্য করেছেনতিনি বলেছেন, লন্ডনের সব অধিবাসীকে কোনোরকম বৈষম্য না করে সমান গুরুত্ব দিয়ে তিনি দেখতে চান, আর এটা প্রমাণ করার সুযোগ তিনি পেয়েছেন

লেবার পার্টির রাজনীতিকরা যখন মেয়র পদে দাঁড়ানোর জন্য তাদের নাম পেশ করেছিলেন, তখন লেবার পার্টির তালিকায় একেবারে পেছনের সারিতে ছিল সাদিক খানের নামসাদিক খানের বাবা আমানুল্লাহ খান এবং মা সেহেরুন খান পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন ১৯৭০ সালে-সাদিক খানের জন্মের কিছুদিন আগেসাদিক খান তাদের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে পঞ্চমতারা সাত ভাই এবং এক বোনসাদিক খান সবসময়েই বলেছেন, শ্রমজগ সম্পর্কে প্রথম জীবনে তার যে ধ্যানধারণা ছিল, সেটাই পরবর্তীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সম্পর্কে তার আদর্শে রূপ নেয়তার বাবা যিনি ২৫ বছর লন্ডনে বাস চালিয়েছেন, সাদিক খান বলেন, তিনি ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন, ভালো বেতন ও কর্মপরিবেশ পেয়েছেন কিন্তু মা বাসায় বসে সেলাইয়ের কাজ করতেন- তিনি তা পাননি

দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের যে তিন কামরার ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন, সেখানে তাদের বড় পরিবারকে গাদাগাদি করে থাকতে হতোস্থানীয় একটি সরকারি স্কুলে তিনি পড়তেন এবং সেখানেই ১৫ বছর বয়সে তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং লেবার পার্টিতে যোগ দেনআর্নেস্ট বেভিন কলেজ নামে ওই স্কুলের প্রধান ছিলেন ব্রিটেনের কোনো মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম মুসলমান প্রধান শিক্ষকখান ছোটবেলা থেকেই মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে লালন করেছেন এবং তিনি বলেছেন, বাবা-মার কাছ থেকে এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন যে, ‘কোথাও অন্যায় কিছু দেখলে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা তোমার কর্তব্যতিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন, ফুটবল, বক্সিং এবং ক্রিকেট অনুরাগী ছিলেন

এমনকি তরুণ হিসেবে তিনি সারে কাউন্টি ক্রিকেট দলেও কিছুদিন ট্রেনিং নিয়েছিলেনতবে তিনি বলেছেন, ফুটবল মাঠে কীভাবে তাকে ও তার ভাইকে বর্ণবাদী মন্তব্য শুনতে হয়েছে, যার কারণে তিনি ঘরে বসে খেলা দেখাই নিরাপদ মনে করতেনপরে তিনি লিভারপুল দলের ভক্ত হয়ে ওঠেনপ্রথমদিকে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছিলেন-ভেবেছিলেন দন্ত চিকিসক হবেনপরে একজন শিক্ষকের পরামর্শে তিনি আইন পড়তে যানওই শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সবসময় তর্ক কর১৯৯৪ সালে তিনি একটি আইন সংস্থায় মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে যোগ দেনওই বছরই তার স্ত্রী সাদিয়া আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ও বিবাহসাদিয়াও আইন পড়তেন এবং কাকতালীয়ভাবে তিনিও বাসচালকের কন্যাতাদের দুই কন্যাসন্তান আছে- আনিসা আর আম্মারাসাদিক খান স্থানীয় প্রশাসনে ১২ বছর কাজ করেছেন২০০৪ সালে আইনজীবীর কাজ ছেড়ে তিনি পুরো সময়ের জন্য রাজনীতিতে যোগ দেন২০০৫ সালে তিনি দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন

রাজনীতিতে বিভিন্ন দলে তার সমসাময়িকরা বলেছেন, সাদিক খান খুবই বুদ্ধিদীপ্তএবং একজন একগুঁয়েব্যক্তি এবং তার যুক্তি খারিজ করে দেওয়া প্রায়ই কঠিন২০১০ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাকারে সাদিক খান বলেছিলেন, ‘আমি উদ্ধৃত কোনো মন্তব্য করতে চাই না, তবে ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, খুব কম মুসলমানকে বলতে শোনা যায় আমি একইসঙ্গে ব্রিটিশ, মুসলমান এবং লন্ডনবাসী- তা নিয়ে আমি গর্বিত

এবারের মেয়র নির্বাচনেও যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের মেয়র পদে টানা তৃতীয়বারের মতো জয় পেয়েছেন ৫৩ বছর বয়সী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খানতিনিই লন্ডনের প্রথম নেতা, যিনি টানা তিনবার এই পদে জয়ী হয়েছেনলেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খান ২ লাখ ৭৬ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী সোসান হলকে হারিয়েছেনএই জয়ের মধ্য দিয়ে লেবার পার্টি আরও শক্ত অবস্থানে চলে গেছেলেবার পার্টির পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছিল, সাদিক খানের জয়ের বিষয়ে দল আত্মবিশ্বাসীলন্ডনের মেয়র পদের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ গত ২ মে বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় শেষ হয়পরে ৩ মে শুক্রবার সকাল থেকে ভোট গণনা শুরু হয়এরপর ৪ মে শনিবার লন্ডন সময় বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের সময় ফলাফল প্রকাশ করা হয়প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, বর্তমান মেয়র সাদিক খান প্রতিদ্বন্দ্বী সোসান হলকে ২ লাখ ৭৬ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেনএবার ১৪টি নির্বাচনী এলাকার নয়টিতেই জিতেছেন সাদিক খানএর মধ্যে কনজারভেটিভদেরও দুটি এলাকা রয়েছেনির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ২৪ লাখ, যা মোট ভোটারের ৪২ দশমিক ৮ শতাংশযদিও ভোট পড়ার হার গতবারের চেয়ে কিছুটা কম

২০১৬ সালে প্রথম লন্ডনের মেয়র হন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সাদিক খানএরপর ২০২০ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন তিনি২০২৪ সালের নির্বাচনেও জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছেন সাদিক খানসাদিক খান ল্যাম্বেথ এবং সাউথওয়ার্ক, বারনেট এবং ক্যামডেন, লন্ডন এবং ইস্টের শহর, মারটন এবং ওয়ান্ডসওয়ার্থ, গ্রিনউইচ এবং লুইশ্যাম, এনফিল্ড এবং হ্যারিঞ্জি এবং নর্থ ইস্টে জিতেছেন- যার সবটিতেই তিনি ২০২১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেনকনজারভেটিভ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী হলের বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারণার মাধ্যমেই সাদিক খান জয়লাভ করেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরাএমনকি লন্ডনের সাবেকমন্ত্রী পল স্কুলিসহ আরও হাইপ্রোফাইল টোরি প্রার্থীদের পেছনে ফেলেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনিজাতীয় নির্বাচনের আগে দেশটির মেয়র নির্বাচনের দিকে সবার নজর ছিলধারণা অনুযায়ী কনজারভেটিভদের চেয়ে জনসমর্থনে এখন অনেক এগিয়ে আছে লেবার পার্টিব্রিটেনের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় নির্বাচনে অনেক এলাকায় বড় ধাক্কা খেয়েছে প্রধানমন্ত্রী সুনাকের দল কনজারভেটিভ পার্টিউল্টোদিকে, বিরোধী দল লেবার পার্টির উত্থান চোখে পড়ার মতো২৬ শতাংশ বেশি ভোট এবার গিয়েছে তাদের দখলেদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই প্রথম এত বড় সাফল্য পেয়েছে লেবার পার্টিশেষ পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, মোট তিনটি কাউন্সিলে হেরে গেছে কনজারভেটিভ পার্টিঅন্তত ১০০ জন কাউন্সিলরও হারিয়েছে তারাতবে বেশ কয়েকটি আসনের ফল ঘোষণা এখনো বাকিব্ল্যাকপুল সাউথের পার্লামেন্টের আসনটি এবার ফিরে পেয়েছে লেবার পার্টিফলে, পার্লামেন্টে একটি আসন হারিয়েছে সুনাকদের দলওই কেন্দ্রের নতুন এমপি ক্রিস ওয়েব কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড জোনসকে হারিয়েছেন

এ ছাড়া রেডিচ, থাররক, হার্টলেপুল, রাশমুরের মতো কেন্দ্রেও স্থানীয় ভোটে জয় পেয়েছেন লেবার প্রার্থীরাশুধু ওল্ডহ্যামে জয় পায়নি তারাসেখানকার মুসলিম সম্প্রদায় গাজা নিয়ে লেবার পার্টির অবস্থানে আদৌ সন্তুষ্ট ননতারা মনে করছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির কথা ভাবেনি লেবার পার্টিতবে দলের এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত লেবার পার্টির নেতা তথা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলনেতা কিয়ার স্টার্মারআজই সাংবাদিকদের স্টার্মার বলেছেন, ‘এই ফল আশা করি ঋষি সুনাককে একটা বড়সড় বার্তা দিতে পেরেছেএবার ওর যাওয়ার পালাব্রিটেনের সাধারণ মানুষ জানতে পেরেছে যে, এই লেবার পার্টি সম্পূর্ণ নতুন রূপে ফিরে এসেছেতাই এবার আমাদের নিজেদের কাজটা করতে দিনদলের এই ভালো ফলের পরে আগামী অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনও এগিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন স্টার্মারলেবার পার্টির মতো কিছু এলাকায় সাফল্য পেয়েছে গ্রিন পার্টিওব্রেক্সিটের সময়ে শুরু হওয়া নাইজেল ফারাজের দল রিফর্ম ইউ কেও অনেক আসনে জয় পেয়েছেসব মিলিয়ে অক্টোবরের নির্বাচনের আগে প্রবল চাপে সুনাক

ভোটের আগে তার দলেরই কিছু এমপি তার পদত্যাগ চাইতে পারেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছেসুনাকের জায়গায় পেনি মরড্যান্টের নাম হাওয়ায় ভাসছেতবে পেনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, বদলি হিসেবে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে তিনি ঢুকতে চান নাতবে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছেআর এই নির্বাচনের মাধ্যমে কনজারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে লেবার পার্টি জয় পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছেসাদিকের এই জয়ের মাধ্যমে ব্রিটেনের বর্তমান বিরোধী দল লেবার পার্টির রাজনৈতিক শক্তি ও সমর্থনের বিষয়টি আবারও ফুটে উঠেছেবিশ্লেষকরা মনে করছেন, কনজারভেটিভ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী সুসান হলের বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারণার মাধ্যমেই সাদিক খান জয়লাভ করেছেনএমনকি লন্ডনের সাবেকমন্ত্রী পল স্কুলিসহ আরও হাইপ্রোফাইল টরি প্রার্থীদের পেছনে ফেলেই নির্বাচিত হয়েছেন সাদিক খানতবে তার দল লেবার পার্টি আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেমন করে সেটাই এখন দেখার বিষয়

লেখক :  যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক

[email protected]

×