ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

থাইল্যান্ড যেভাবে এগিয়ে

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:৫০, ৯ মে ২০২৪

থাইল্যান্ড যেভাবে এগিয়ে

.

অনেকদিন পর গেলাম থাইল্যান্ডে। আগেও বেশ কয়েকবার থাইল্যান্ড ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। তবে কোভিড-১৯ এর পর এটাই প্রথম। আজকাল থাইল্যান্ড ভ্রমণ অনেকের কাছে ডাল-ভাত হয়ে গেছে। অনেকেই আছেন যারা চিকিৎসা সেবা নিতে প্রায়ই থাইল্যান্ড যায়। আবার কেউ কেউ ভেকেশনে যায়। আমি মূলত বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই গিয়েছি। কেন যেন দেশটি খুব ভালো লাগে। ঢাকা থেকে মাত্র আড়াই ঘণ্টার জার্নি। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ব্যাঙ্ককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর। সত্যি কথা বলতে কি, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার দীর্ঘ ভ্রমণ বড্ড টায়ারিং, যা বরাবরই আমার অপছন্দ। সেদিক দিয়ে থাইল্যান্ডের তুলনা থাইল্যান্ড-ই।

দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখ-ের কেন্দ্রে অবস্থিত। ঐতিহাসিক নাম শ্যামদেশ এবং দাপ্তরিকভাবে থাইরাজ্য বলা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য শ্যামদেশের পরিবর্তে থাইল্যান্ড নামকরণ করা হয়। দেশটিতে রয়েছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক নয়নাভিরাম দৃশ্য। নজরকাড়া অসংখ্য স্থানের জন্য এটি পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, চাও ফ্রায়া নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি প্রাণবন্ত রঙিন শহর। আর এই রঙিন শহরে গিয়ে নিজেদের একটু সজিব করে তুলতে কে না চায়?

থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্রের শাসন চলে। বর্তমানে আর্থিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে এটি একটি আঞ্চলিক শক্তির নাম। কোটি মানুষের দেশ থাইল্যান্ডে প্রায় ৭০টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। তবে সরকারি ভাষা হলো থাই। বৌদ্ধ ধর্ম প্রধান ধর্ম। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলাম ধর্ম। দেশটিতে ৪০ হাজারের বেশি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। পুরো থাইল্যান্ডজুড়ে মন্দিরের ছড়াছড়ি। থাই ভাষায় মন্দিরকে বলা হয়ওয়াট দর্শনীয় স্থান হিসেবে বৌদ্ধ মন্দিরগুলো খুবই আকর্ষণীয় জায়গা। তবে থাইল্যান্ড মুসলমানদের দ্বিতীয় জনগোষ্ঠী হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী অনেক মসজিদ ইসলামিক স্থাপনাও রয়েছে।

স্বল্প খরচে ভ্রমণের জন্য পুরো বিশ্বের পর্যটকদের কাছে থাইল্যান্ড অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি দেশ। পর্যটনবান্ধব দেশটির পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে মূলত সমুদ্র সৈকত অজস্র দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে। বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের তালিকায় দেশটি রয়েছে শীর্ষে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাইল্যান্ড বেড়ানোর মজাটাই অন্য রকম। জিভে জল আনে এমন বহু সুস্বাদু খাবার মেলে ব্যাংককে। থাই খাবার যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি এর খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাই বছরের পর বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে ব্যাংকক এক অনন্য আকর্ষণ। অন্যদিকে আতিথেয়তার দিক থেকেও ব্যাঙ্ককের জুড়ি মেলা ভার।

ব্যাঙ্ককে গিয়ে চায়না টাউনের বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড ট্রাই করতে কিন্তু ভুল করবেন না। মুখরোচক খাবারের এক অপূর্ব সমাহার রয়েছে এই মার্কেটে। কি নেই এখানে! পেঁপের সালাদ, আম মিশ্রিত স্টিকি রাইস, থাই অমলেট উইথ স্টিমড রাইস, নুডলস স্যুপ, স্পাইসি থাই সি ফুড, থাই ফ্রাইড নুডলস ইত্যাদি ব্যাঙ্ককের জনপ্রিয় খাবার। ব্যাঙ্ককের ফলও খুবই মজাদার সুমিস্ট। রাস্তার দুই পাশে ভ্যানের মধ্যে হরেকরকম রঙিন ফল বিক্রি হচ্ছে। যেমন-বিচি ছাড়া পেয়ারা, ড্রাগন ফল, আম, পেঁপে, কলা, তরমুজ, লংগন, রাম ভুটান ইত্যাদি। আমার সবচেয়ে পছন্দ রাম ভুটান। ফলটি দেখতে একটু অন্যরকম হলেও খেতে খুব মজা। ভেতরটা অনেকটা লিচুর মতো।

আমরা বাংলাদেশীরা ব্যাংকক গেলে সাধারণত যে হোটেলগুলোতে উঠি তার বেশির ভাগই সুকুম্ভিত এলাকায় অবস্থিত। আমিও ব্যতিক্রম নই। বড় সুবিধা হলো পাশেই বাঙালি রেস্তোরাঁ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। হাতের কাছে সবই পাওয়া যায়। আশপাশের অন্যান্য হোটেলগুলোতেও বাংলাদেশীদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। বাঙালিদের এসব দোকানে মোবাইল সিম থেকে শুরু করে ডলার কেনাবেচা, প্লেনের টিকিটসহ সবকিছুই পাওয়া যায়। তবে এসব দোকানের সাইড বিজনেস হলো ট্যুর প্যাকেজের মধ্যস্থতা হিসেবে কাজ করা।

থাইল্যান্ডে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তাহলো তারা তাদের মাতৃভাষাকে সম্মান করে। পুরো শহরে এমন কোনো সাইনবোর্ড বা ব্যানার খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে থাই ভাষা লেখা হয়নি। তবে কোথাও কোথাও টুরিস্ট এলাকায় থাই ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিও আছে। থাইরা বলতে গেলে ইংরেজি জানেই না। তারপরও আকারে ইঙ্গিতে ম্যানেজ করে নেয়। তবে এর জন্য তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে না। জাতি হিসেবে এরা যেমন উদ্যোগী, তেমনি পরিশ্রমী। আর জন্যই সবকিছু ছাপিয়ে তাদের অগ্রগতি সবার নজর কাড়ে।

ব্যাঙ্কক শহরটি এখন চিকিৎসা সেবার একটি বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক ধনী সিঙ্গাপুর বা লন্ডনে চিকিৎসা সেবা নিতে যায়। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ অনেক জনপ্রিয় একটি চিকিৎসা কেন্দ্র, যা বিশ্বমানের সেবা প্রদান করে থাকে। তাদের স্বাস্থ্যসেবাও ব্যয়বহুল। ব্যাঙ্ককের বামরুনগ্রাদ হসপিটালটিও ধনী ব্যক্তিদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। ঢাকায় এদের অফিসও আছে। তবে এটির পাশাপাশি ব্যাংককে আরও কয়েকটি হসপিটাল রয়েছে। তন্মধ্যে ব্যাংকক হসপিটাল অন্যতম।

সুকুম্ভিত থেকে বামরুনগ্রাদ হসপিটাল খুব কাছেই। যেখানে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য প্রচুর বাংলাদেশীর সমাগম ঘটে। হসপিটালে হাঁটতে গেলে দুই চারজন বাংলাদেশীর সঙ্গে ধাক্কা লাগাটাই যেন স্বাভাবিক। থেকে বোঝা যায় চিকিৎসার নামে বাংলাদেশের মানুষ কত বিপুল পরিমাণ টাকা দেশে ব্যয় করে। আমার ধারণা, বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি লোক ভারতে যায়। তারপরেই থাইল্যান্ডের স্থান।

এটাও ভাবি যে, বাংলাদেশ থেকে এত লোক চিকিৎসা নিতে ভারতে যায় কিংবা থাইল্যান্ড আসছে। তাহলে কী এসব লোক বাংলাদেশে অপচিকিৎসার শিকার হয়েছে? কিংবা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা মানসম্পন্ন নয়? জন্যই কী তারা বিদেশমুখী? আমার এক বন্ধু মাঝে মধ্যেই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে যান। একদিন তাকে বললাম, দেশেও তো চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। তাহলে ভারত কেন যাও? উত্তরে বন্ধু জানালো, সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চ মানের চিকিৎসা নিতেই সে ভারতে যায়।

একসময় থাইল্যান্ডও আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। তাদের অবকাঠামো বা সেবা কোনোটাই আমাদের চাইতে ভালো ছিল না। বরং কুখ্যাতি ছিল সেক্সট্রেডে নিমজ্জিত একটি দেশ হিসেবে। সেই দেশ এখন কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের আরও বহুদেশের চিকিৎসা কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, এমনকি ম্যাজিক ওদের আছে যা আমাদের নেই! স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হয়ে গেলেও স্বাস্থ্যখাতে কেন আমাদের এই দৈন্যদশা? আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেন এতটা ভঙ্গুর? কেন আমাদের ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা লন্ডনে যেতে হয় চিকিৎসা নেওয়ার জন্য?

এক সময়ের শ্যামদেশ, বর্তমানে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। কী নেই এই দেশে? আধুনিক শহরের আলোর ঝলকানি থেকে শুরু করে পাহাড়ের ভাঁজে ছোট্ট গ্রাম আর বিশাল সমুদ্রের গর্জন, বেলাভূমি, কোরাল দ্বীপ, ওয়াকিং স্ট্রিটে লাইভ ড্যান্স শো, মিউজিক শো, স্ট্রিট ফুডসহ হরেকরকমের আয়োজন রয়েছে এই শহরের পথে প্রান্তরে। এছাড়া রয়েছে বড় বড় সব অট্টালিকার ভিড়, শপিং মল, আকাশছোঁয়া স্কাই ট্রেনে চোখের পলকে শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটে চলা। ব্যাঙ্ককের এই ছোট্ট নদী চাও ফ্রায়াকে ঘিরে ওদের কতই না কর্ম চাঞ্চল্য আর উদ্দীপনা। নদীকে ঘিরে ওদের ব্যবসায়িক পরিমন্ড দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। যে কাজটা করা উচিত ছিল আমাদের, সেই কাজটা করেছে ব্যাংককবাসী।

চাও ফ্রায়া নদীকে কেন্দ্র করে প্রচুর রিভার ক্রুজ পরিচালিত হচ্ছে। নদীর দুই পারে গড়ে উঠেছে কত পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল আর রেস্তোরাঁ। রাতের বেলা নদী পারের স্থাপনাগুলো রং-বেরঙের আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে। ডাইনিং ক্রুজের বড় বড় জাহাজ ছাড়াও ছোট বোট নৌকাগুলোকেও আলোক সজ্জায় সাজিয়ে রিভার ক্রুজ পরিচালনা করা হচ্ছে। নদীর দুই পাশে স্থাপনাগুলো ঝলমলে আলোর প্রতিফলনে মনে হয় যেন স্বপ্নপুরী। অনেক আকর্ষণের ভিড়ে চাও ফ্রায়া নদী পারের এলাকাটি পর্যটকদের প্রিয় একটি গন্তব্য। আর লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দোকানে দোকানে, রাস্তা ঘাটে, বড় বড় হোটেলে বিক্রি হচ্ছে নানা রকম ভ্রমণ প্যাকেজ। চাও ফ্রায়া নদীর অবদানের কথা বিবেচনা করেই ব্যাংকক শহরকে  ‘প্রাচ্যের ভেনিসনামে অভিহিত করা হয়। থাইল্যান্ডের আহামরি তেমন সম্পদ নেই। তবে জাতি হিসেবে তারা খুব উদ্যোগী পরিশ্রমী। তাদের মূল চালিকাশক্তি হলো পর্যটন আর কৃষি। দুটো মাত্র পুঁজিকে সম্বল করে সততা নিষ্ঠাসহকারে তার সদ্ব্যবহার করে থাইল্যান্ড আজ আর্থিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ব্যুরো বাংলাদেশ

×