
.
বুয়েট বা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ঐতিহ্যবাহী ও শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৭৬ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তার জরিপ কাজের সুবিধার্থে ‘ঢাকা সার্ভে স্কুল’ নামে এটি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯০৫ সালে এটি শিক্ষানুরাগী ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহর অনুদানে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করে ১৯০৮ সালে ‘আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৬২ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘ইপুয়েট’ নামে যাত্রা শুরু করে।
রক্তের প্রস্রবনে জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ১৯৭২ সালে ‘ড. কুদরত-ই খুদা’ নামে বঙ্গবন্ধু এক অভূতপূর্ব বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। ১৯৭৩ সালের ২০ মার্চ বুয়েটের প্রথম সমাবর্তনে বুয়েটের মাটিতে দাঁড়িয়েই তিনি তাঁর কালজয়ী শিক্ষাদর্শন ব্যক্ত করেছিলন। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে ভাবতেন যে, ব্রিটিশের ২০০ বছর এবং পাকিস্তানের ২৩ বছরের গোলামির শিক্ষা আমাদের শুধু কেরানিই বানিয়েছে, মানুষ বানায়নি। তাই এই অনুৎপাদনশীল পরনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে উদ্ভাবনী শিক্ষা সৃষ্টি করে একটি স্বনির্ভর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। এ লক্ষ্যে শিক্ষাকেই তিনি প্রধান হাতিয়াররূপে বেছে নিয়েছিলেন। সেই আমলেই তিনি শিক্ষায় সর্বোচ্চ তথা জাতীয় আয়ের ২২% পর্যন্ত বরাদ্দ রেখেছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি করেন এবং স্বায়ত্তশাসনের আওতায় এগুলোকে জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত লীলা ক্ষেত্রে পরিণত করেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। অথচ এই বুয়েটের এক শ্রেণির শিক্ষার্থীর দাবির প্রেক্ষিতে সেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে শুধু দেশের রাজনীতির ঐতিহ্যিক ধারাকেই ম্লান করার চেষ্টা করা হয়নি, বরং বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী মহান রাজনৈতিক দর্শনকেও প্রজন্মের মাঝে প্রকারান্তরে ম্লান করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।
’৭৫ পরবর্তী অগণতান্ত্রিক পন্থায় উত্থিত দুই সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের শাসনামলেও এমনটি ঘটেছিল। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও শোষকদের মতো তারা দেশে সৃজনশীল মুক্তমত চর্চা অবরুদ্ধ করে রেখে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছিল। যার দীর্ঘ বিকৃত প্রভাবে রীতিমতো একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে কতিপয় ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা করে। এ ঘটনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল জড়িত ২০ জনকে মৃত্যুদ- ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন। উচ্চ আদালতে এটি বিচারাধীন থাকায় রায় কার্যকর হয়নি। বিষয়টি ঘিরে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন এখানে সকল প্রকার রাজনৈতিক চর্চা নিষিদ্ধ করে। এতে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিক্ষার্থী ও তাদের প্রভাবক গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের একটি দূরভিসন্ধি চরিতার্থ হয়। অথচ একই ক্যাম্পাসে ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে বুয়েট ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি এবং ২০১৩ সালে বুয়েট ছাত্র ও শাখা ছাত্রলীগের নেতা আরিফ রায়হান দীপকে ধর্মান্ধ হেফাজতে ইসলামের কর্মী ও বুয়েট শিক্ষার্থী চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। কিন্তু এদের বিষয়ে কখনোই এখানকার শিক্ষার্থীদের একটা শ্রেণি সরব হয়নি।
বরং শুধু ফাহাদের মৃত্যুকেই আবেগী পুঁজি করে দীর্ঘ পাঁচ বছর বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের আড়ালে কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরির ও জামায়াতের শিবিরকে গোপনে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে মর্মে অভিযোগ আছে। যৌথভাবে তাদের বিতর্কিত সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল মর্মে মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের সেখানকার প্রগতিশীল শিক্ষার্থী ও একাধিক গণমাধ্যমের তদন্তে উঠে এসেছে। সর্বশেষ গত বছরের ৩০ জুলাই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়ে শিবিরের ২৪ জন নেতাকর্মী গোপন বৈঠক হতে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে তারা এই কার্যক্রম চালায়। হিজবুত তাহরি কিউ আর কোডের মাধ্যমে চতুর কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এমতাবস্থায় সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ পক্ষের শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রাহিমের সিট বুয়েট প্রশাসন তৎক্ষণাৎ বাতিল করে। কোনো তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াই বুয়েট প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত সচেতন মহলে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এতে বুয়েট প্রশাসন তার স্বকীয়তা হারিয়েছে, যা কখনোই শোভনীয় নয়। এতদ্বিষয়ে বুয়েট ভিসির প্রতিক্রিয়াও সচেতন মহলকে হতবাক করেছে। এতে তার দুর্বল ব্যবস্থাপনার প্রকাশ ঘটেছে।
রাজনীতি নিষিদ্ধের মাধ্যমে বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে এখানে জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয়নি। পালিত হয়নি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যরে অনুষ্ঠানাদি। সর্বশেষ উচ্চতর আদালত বুয়েটে রাজনীতি চলতে বাধা নেই মর্মে রায় প্রদান করেছেন। প্রশ্ন হলো, রাজনীতি উন্মুুক্তের ক্ষেত্রে কেন আদালতের শরণাপন্ন হতে হলো? এর জন্য কি বুয়েট কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায় ছিল না? উল্লেখ্য, দ্রুত সময়ে আবরার ফাহাদের বিচার ঘোষিত হয়েছে (যদিও সনি ও দীপের বিচার আজও সম্পন্ন হয়নি)। তারপরেও সংঘটিত ঘটনায় কেন ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকবে? সংঘটিত ঘটনা তো বিচারাধীন। শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিরুদ্ধে বা রাজনীতি প্রতিহতে ভূমিকা রাখা কখনোই সচেতন প্রকাশ হতে পারে না। বরং রাজনীতির নামে দেশের জাতীয়তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সেই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াই হতো আদর্শিক পরিচয়। কিন্তু অন্যের সাধারণ রাজনৈতিক অধিকারে বাধা প্রদান শুধু সংবিধানবিরোধী অপতৎপরতাই নয়, মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন বটে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, মহামান্য আদালতের নির্দেশনার বিরুদ্ধেও তারা প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে, যা স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর মতো দেশের বিচার বিভাগকে অবমাননার শামিল।
’৭৫ পরবর্তী এদেশের আবহমান সৃজনশীল রাজনীতি তার পথ হারিয়েছে। বিনষ্ট হয়েছে রাজনীতির ঐতিহ্যিক ধারা। জাতীয় স্বার্থে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কি দায় নেই জাতীয় রাজনীতিকে সংস্কার করার? মেধাবী হলেই কি সে সামাজিক দায়বদ্ধতার বাইরে? ২০২২ সালের ইউজিসি’র তথ্যানুযায়ী বুয়েটের শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৭৭ টাকা, যা জনগণেরই টাকা। সেই হিসাবে একজন শিক্ষার্থীর পূর্ণ কোর্স অবধি রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু আমরা অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি দেশকে অবহেলা করে স্কলারশিপের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি জমাতে। অনেককেই দেখেছি সরকারি কর্মজীবনে দুর্নীতিবাজ হতে। স্বাধীনতার পূর্বাপর দেশের অনেক প্রখর মেধাবীকে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেও দেখেছি। রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থানও এক ধরনের অপরাজনীতি। যে মেধা রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, জাতিসত্তাকে আঘাত করে সেই মেধা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। প্রকৃত রাজনীতির মাধ্যমে মননশীলতার বিকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়। জাগ্রত হয় মানবিকতা ও সুনাগরিকতা। তাই বিরাজনীতি নয়, বরং সুস্থ ধারার রাজনীতির মাধ্যমে বুয়েট তার স্বমহিমায় ফিরে আসুক- এই শুভ প্রত্যাশায় আমরা।
লেখক : সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-যশোর