ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

আটশ’ কোটি ডলারের জলবায়ু তহবিল

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

আটশ’ কোটি ডলারের জলবায়ু তহবিল

.

দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। সবার অর্থায়নে গড়ে উঠবেবাংলাদেশ জলবায়ু উন্নয়ন প্ল্যাটফর্ম’ (বিসিডিপি) নামের এই তহবিল, যার আকার হবে প্রায় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। তহবিলের অর্থ খরচ হবে সহযোগিতামূলক পদ্ধতিতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তাই বিসিডিপি বাস্তবায়নে আইএমএফের সহযোগিতা পরামর্শ থাকবে সব সময়। আর অর্থ ব্যয় হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব জনগোষ্ঠীর জীবনমান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছেতাদের জন্য। বিশ্বায়নের প্রকটতায় গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় পৃথিবীর অনেক অংশই ঝুঁকির মুখোমুখি অবস্থান করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় যারা সরাসরি ভুক্তভোগী, তাদের জীবনমান উন্নয়নে বিজয়ের মাসে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণান্তে সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে থাকে।

অনেকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক পরিসরে জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতা অনুধাবন এবং সংকট মোকাবিলার তাগিদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব ফোরামে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশসমূহকে জলবায়ু খাতে বেশি পরিমাণে ভর্তুকি প্রদানের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছে। প্রকৃত অর্থে যাদেরকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে জানি, বিভিন্ন কারণেই কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও তাদের থেকে বেশি পরিমাণে হয়। সঙ্গত কারণেই জলবায়ু মোকাবিলায় গঠিত জলবায়ু ফান্ডেও তাদের তুলনামূলক অংশগ্রহণ বেশি থাকা বাঞ্ছনীয়। বিষয়ে সোচ্চার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের নিকট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস পর্যাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে থাকে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নেতৃত্ব প্রদান করছে বাংলাদেশ।

জলবায়ু সংকট মোকাবিলার নেতৃত্বে বাংলাদেশের তাৎপর্যময় এবং অংশীদারিত্ব ভিত্তিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সকল সংগঠন মুখপাত্রের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। তারই ধারাবাহিকতায় বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠনের সুসংবাদ পেল বাংলাদেশ। আইএমএফ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), বহুপক্ষীয় বিনিয়োগ নিশ্চয়তা এজেন্সি (এমআইজিএ), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), এজেন্সি ফ্র্যান্সাইস দ্য ডেভেলপমেন্ট (এএফডি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি), গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ), কোরিয়া সরকার এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) আইএমএফের পাঠানো বিবৃতিতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেবে এডিবি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এখন ৪০ কোটি মার্কিন ডলার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২৩ সালের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৯০ কোটি ডলার, যার ৫৩ শতাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করার কথা। ছাড়া ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এডিবি ৫৫০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশই থাকছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়।

মোট ৮০০ কোটি ডলারের মধ্যে আইএমএফের অংশ হচ্ছে ১৪০ কোটি ডলার। গত জানুয়ারিতে আইএমএফ যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, তার মধ্যেই এটি অন্তর্ভুক্ত। ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ১০০ কোটি, এআইআইবির ৪০ কোটি এবং কোরীয় সরকারের কোটি ডলার থাকছে। অন্য সংস্থাগুলোরও কমবেশি অর্থায়ন থাকছে। আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, ‘জলবায়ু সহনশীলতা, অভিযোজন, প্রস্তুতি সংরক্ষণকে আরও শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা জলবায়ু কর্মসূচি বাস্তবায়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বৈশ্বিক সম্মিলিত উদ্যোগের প্রচারে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করি।তিনি বলেন, ‘জলবায়ু ঝুঁকি বৃদ্ধির ঘটনা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন জীবিকাকে প্রভাবিত করছে। তবে দুর্যোগ প্রস্তুতি অভিযোজনের ক্ষেত্রে দেশটি ভালো করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। জন্য পারস্পরিক জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অর্থায়নের জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।এডিবি প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ শক্তিশালী অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। যথাযথ নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে জলবায়ু কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্য সব উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে মিলে এডিবিও বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।

জলবায়ু সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন নিয়ে বিশ্লেষকগণ ইতিবাচক সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন। তবে যে বিষয়টিতে সকলেই গুরুত্ব দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলোÑ তহবিল খরচের সময় জবাবদিহি দায়বদ্ধতার জায়গায় সরকারকে ব্যাপক নজরদারি করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠনের নিমিত্তে অনেক কারণকে তুলে ধরা যেতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রগতির লক্ষ্যে কৃষিভিত্তিক সমাজের যে ভিত্তি, সেটিকে ক্রমান্বয়ে সুদৃঢ় করার উদ্দেশে আন্তর্জাতিক সংস্থা সংগঠনগুলো জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের উদ্দেশে তহবিল গঠনের কাজে হাত দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা প্রতিহতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বত্র সোচ্চার। তাই স্টাডি এরিয়া হিসেবে গ্রহণ করে সফলতা-ব্যর্থতার কার্যকারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে অন্যতম সেরা অভিলক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যেই বাংলাদেশের জন্য ৮০০ কোটি ডলার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ তার অর্জনের পাল্লায় ব্যতিক্রমতা হিসেবে যে অর্জনগুলো দেখিয়েছে বিশ্ব ব্রহ্মা, সে সকল কাজ নিয়ে অনুসরণ করা হয়। সেই লক্ষ্যেই মূলত জলবায়ু সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশী মডেল অনুসরণ করার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

চতুর্থত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেহেতু জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সোচ্চার আগ্রহী, সেহেতু তাঁর নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালিত হলে আন্তরিকতা জবাবদিহির জায়গায় স্পষ্টত থাকায়, তহবিল সংক্রান্তে দুর্নীতি অনুপস্থিত থাকায় প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে।

বিশ্ব রাজনীতিতে যেহেতু জলবায়ু প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রশংসিত, সেহেতু বিদ্যমান জলবায়ু সংকটকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জলবায়ু তহবিল গঠন করা হয়েছে। তাছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে বিবেচনাতেও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত তহবিল গঠিত হলে জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান সংকটকে মোকাবিলা করে আগামীতে এই সেক্টরে শক্তিশালীভাবে বৃহৎ পরিসরে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ। আগামী বিশ্বে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন মূলত বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত বহন করে থাকে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সঠিক উপায়ে তহবিলের টাকা খরচ করে জলবায়ুর উষ্ণতাকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে এনে কৃষিভিত্তিক বিশ্বে পরিপূর্ণ শক্তির রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগের পাশাপাশি, নতুন শিশুর জন্য পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ৮০০ কোটি টাকার তহবিল বেশ গুরুত্ব বহন করে থাকে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

×