ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

পানি ব্যবহারে টেকসই ব্যবস্থাপনা

আবদুল হাই রঞ্জু

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৪ অক্টোবর ২০২৩

পানি ব্যবহারে টেকসই ব্যবস্থাপনা

মানুষের জীবনধারণের জন্য পানি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান

মানুষের জীবনধারণের জন্য পানি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। পানি ব্যতীত প্রাণিজগৎ, গাছপালা, তরুলতার বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। সে অর্থে বলা হয় ‘পানির অপর নাম জীবন।’ পানি শুধু আমাদের তৃষ্ণাই মেটায় না, প্রতিদিন আমাদের যে পরিমাণ ক্যালরি শরীর থেকে খরচ হয়, এর ৮০ শতাংশ পূরণ করে পানি। আমরা মনে করি, পানি একটি সাধারণ উপাদান, যা শুধু তৃষ্ণা মেটায় কিংবা গোসল, ওজুর প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে তা নয়। শুধু তাই নয়, জীবদেহের একক ‘কোষ’ হিসেবে  প্রোটোপ্লাজমের ৯০ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি হয়।

যদি কোনো কারণে দেহে পানির অভাব হয়, তাহলে এই প্রোটোপ্লাজমগুলো কুঁচকে যায় এবং নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে, বিপাকীয় কাজগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় এবং জীব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। যেমনÑ ডায়রিয়া, কলেরা হলে মানুষের শরীর থেকে পানি বের হতে থাকে। তা পূরণ করতে না পারলে পানি শুষ্কতায় মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। সে অর্থে পানি একটি অত্যাবশীয় উপাদান। যার অনুপস্থিতিতে জীব মাত্রই বেঁচে থাকা কঠিন। 
আবার পানি বিশুদ্ধ না হয়ে যদি দূষিত হয়, তাহলে সেই পানি মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, মাত্র এক ফোঁটা নোংরা পানিতে পাঁচ কোটির বেশি জীবাণু থাকতে পারে। বন্যা ও খরা বিশুদ্ধ পানির উৎসকে ধ্বংস করে দেয়। পরিণামে কলেরা, ডাইরিয়া, টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পাইপলাইনের পানির ৮০ শতাংশেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। পুকুর ও টিউবওয়েলের পানিতেও এই ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মেলেছে।

মানুষের পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়। এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে চর্মরোগ, যকৃত বিকল, কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট, মস্তিষ্কের ক্ষতিও হতে পারে। উক্ত গবেষণার মতে, পানি দূষণের কারণে প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ১৪০০’র বেশি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৮০ জন লোকের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ এই অবস্থাতে মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পানি শুধু পান করার জন্য নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন বহুবিধ কাজের প্রধান উপকরণ হলো পানি। ফলে, তাবৎ দুনিয়ায় পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি চাষাবাদে মিষ্টি পানির ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। শিল্পকলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ২০ শতাংশ, আর ১০ শতাংশ পানি ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন ঘড়-গৃহস্থালির কাজে। অর্থাৎ অবিরাম পানির ব্যবহার নিশ্চিত করেই আমরা বেঁচে আছি।

নদী-নালা, সাগর, মহাসাগর এমনকি ভূগর্ভের পানিও যে ধারা অব্যাহত রয়েছে, তা দেখে আমাদের ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক পানি অফুরন্ত। বাস্তবেও কি তাই? না, পানি অফুরন্ত নয়। মানুষের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ উত্তোলন করতে করতে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে। সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানি, চাষাবাদের পানি প্রাপ্তি খুবই কঠিন। শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলেই নয়, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার অবস্থা কম-বেশি একই রকম। এসব এলাকার সেচভিত্তিক ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। এখন উত্তরাঞ্চলকে বলা হচ্ছে ‘খাদ্য ভাণ্ডার’। যা শুধু সম্ভব হয়েছে সেচভিত্তিক চাষাবাদের বদৌলতে।

কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অব্যাহত থাকলে এমন এক সময় আসবে, যখন সহসাই খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার নিয়ামক পানিও দুষ্পাপ্য হয়ে পড়বে। বিশ্বে এখনই ৭৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান না। ছোট বেলা থেকে পড়ে আসছি, পৃথিবীর ৩ ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। প্রকৃত অর্থে এই হিসাব আরও সূক্ষ্ম। ভূপৃষ্ঠের ৭০.৯ শতাংশ অংশজুড়ে পানির অবস্থান। এর মধ্যে পৃথিবীতে প্রাপ্ত পানির ৯৬.৫ শতাংশ মেলে মহাসাগরে। যা লবণাক্ত।

মাত্র ১.৭ শতাংশ পাওয়া যায় ভূগর্ভে। আর ১.৭ শতাংশ পাওয়া যায় হিমশৈল ও তুষার হিসেবে। সামান্য কিছু পাওয়া যায় অন্যান্য বড় জলাশয়ে। আর কিছু পাওয়া যায় বায়ুম-লে অবস্থিত মেঘ, জলীয় বাষ্প, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত থেকে। অর্থাৎ পৃথিবীর পানির মাত্র ২.৭ শতাংশ হলো বিশুদ্ধ পানি এবং বাকি ৯৭.৩ শতাংশ হলো লবণাক্ত পানি ও বরফ। বিশুদ্ধ পানির ০.৩ শতাংশের কম পাওয়া যাচ্ছে নদীতে, হৃদে ও বায়ুম-লে।
প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ ভূগর্ভস্থ পানি অধিক হারে উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক পানি সম্পদের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। এই চাপ মোকাবিলায় নদী অববাহিকায় উজানের দেশগুলো কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণ করতে সুবিশাল বাঁধ বা ব্যারাজ নির্মাণ করছে। ফলে, ভাটির দেশের মানুষরা প্রাকৃতিকভাবে উজানের পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য ভূগর্ভস্থ পানি মাত্রাতিরিক্তভাবে উত্তোলন করায় উত্তারঞ্চলের অনেক জেলার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বদলে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে তো বটেই, এমনকি বর্ষা মৌসুমেও উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রে পানির বড়ই অভাব দেখা যায়।

বিশেষ করে তিস্তার উজানে ভারত গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণ করে কখনো একতরফা পানি প্রত্যাহার বা কখনো উজানের পানির বাড়তি চাপ কমাতে গজলডোবার গেট খুলে দিলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তায় বন্যা দেখা দেয়। এই হচ্ছে বাস্তবতা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি চুক্তি হওয়া একান্ত আবশ্যক। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও আশ্বাস ব্যতীত কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যে কারণে উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এমনকি পানির স্তর নেমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো জেলায় পানিতে আর্সেনিকের দেখাও মিলছে। আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করে মানুষ চর্ম রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। 
যে কারণে পানি ব্যবহারের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্বার্থে পানি ব্যবহারে যেমন মিতব্যয়ী হতে হবে, তেমনি সেচভিত্তিক চাষাবাদ থেকে সরে এসে বিনা বা অল্প পানিতে ধান, পাট, সবজি উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি কৃষিবিদদের উদ্ভাবন করতে হবে। এমনকি নদীর পানি, সাগরের লবণাক্ত পানিকে পরিশোধন করে কৃষি চাষাবাদের পাশাপাশি খাওয়ার উপযোগী করতে হবে। তাহলেই শুধু ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির আধারকে আমরা রক্ষা করতে পারব। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ উপযোগী মেগা প্রকল্প গোটা দেশে স্থাপন করতে হবে। এ জন্য প্রতিবছর বাজেটে বড় বরাদ্দ রেখে পানি ব্যবহারে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, যা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। 
লেখক : সমাজকর্মী

×