
সম্পাদকীয়
সমাজে বিচিত্র বৈষম্য প্রকটভাবে উপস্থিত আয়বৈষম্য প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়িয়ে তুলছে। শিক্ষার্জনকারী এবং শিক্ষাবঞ্চিতদের মধ্যেও রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। কিন্তু প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে মৌলিক মানবিক প্রয়োজন এবং বেঁচে থাকার অধিকার। আমাদের জাতীয় কবির এই অমর বাণী মনে পড়ে- গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই/নহে কিছু মহীয়ান। কথাগুলো আসছে কষ্টবোধ থেকে। এক দেশে চাকরিজীবীদের জন্য দুই ধরনের নিয়ম কিভাবে চলে! খোলাসা করেই বলা যাক। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির মতো অর্জনে মুনাফার ওপর কোনো কর নেই। পক্ষান্তরে, বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেলায় রয়েছে। সম্প্রতি সেটি এক ধাপে অনেকটাই বাড়ানো হয়েছে।
আগে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি ফান্ডের টাকা বিনিয়োগ করলে যে সুদ বা মুনাফা পাওয়া যেত, তার ওপর ৫ থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর বসত। নতুন আয়কর আইনে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির মতো তহবিলে সাড়ে ২৭ শতাংশ কর বসানো হয়েছে। কর আদায় বাড়াতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর আহরণে সংস্থাটির এবার নজর পড়েছে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ভবিষ্যৎ তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) ও আনুতোষিক তহবিলের (গ্র্যাচুইটি ফান্ড) আয়ের ওপর। এতে বেসরকারি চাকরিজীবীরা ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা তুলতে গেলে আগের চেয়ে কম টাকা পাবেন। অন্যদিকে, সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে এসব তহবিলের আয়ে আগের মতোই করমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
ফলে, করদাতা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন চাকরিজীবী ভবিষ্যৎ তহবিলে প্রতি মাসের বেতন থেকে আড়াই হাজার টাকা জমা রাখেন। প্রতিষ্ঠানও ওই ব্যক্তির জন্য আড়াই হাজার টাকা রাখে। দুটি মিলিয়ে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা এবং বছরে ৬০ হাজার টাকা জমা হয়। এই টাকা কোনো ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে জমা রাখলে বছরে যদি ১০ শতাংশ বা ৬ হাজার টাকা মুনাফা পাওয়া যায়, তাহলে আগে ১০ শতাংশ হিসেবে উৎসে কর কেটে রাখা হতো ৬০০ টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে হিসাবটি পাল্টে যাবে। বছর শেষে ওই ব্যক্তির ভবিষ্যৎ তহবিলের অংশের ওপর মোট কর বসবে ১ হাজার ৬৫০ টাকা। উৎসে করের ৬০০ টাকা বাদ দিলে তাকে ১ হাজার ৫০ টাকা বাড়তি কর দিতে হবে। নতুন নিয়মে এক বছরে তার লোকসান হবে ১ হাজার ৫০ টাকা।
বর্তমানে দেশে প্রায় ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। বেসরকারি খাতে এই সংখ্যা এক কোটির বেশি। চাকরিজীবীরা সারাজীবন একটু একটু করে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা রাখেন। অবসরের পর এটি সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। এখন বাড়তি কর নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে এটি কাম্য নয়। আধুনিক রাষ্ট্র সব সময়ই বৈষম্য বিলোপের পক্ষে। সমাজে কোনো ধরনের বৈষম্যই কাম্য নয়। দেশের মানুষের প্রত্যাশা, কোটি বেসরকারি চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে নতুন করে করের বোঝা চাপানোর পদক্ষেপ থেকে সরে আসবে এনবিআর।