ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ বপন করেছেন বঙ্গবন্ধু

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২০:১৮, ২৬ মার্চ ২০২৩

ডিজিটাল বাংলাদেশের  বীজ বপন করেছেন বঙ্গবন্ধু

.

(গত সোমবারের পর)

) প্রযুক্তি : তথ্যপ্রযুক্তিসহ আধুনিক প্রযুক্তির গুরুত্ব বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন বহু আগেই। ১৯৭১ সালে যখন দেশ স্বাধীন হয় তখন বিশ্বের তৃতীয় শিল্প বিপ্লব চলছিল। দেশের মানুষ যাতে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে পারে সেজন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে আইটিইউ (International Telecommunication Union)-এর সদস্যপদ লাভ করে। একই বছর বাংলাদেশ ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকেও তিনি সক্রিয় করে তোলেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই ৫৫ হাজার টেলিফোন চালুর ব্যবস্থা করেন। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ সহজেই সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। তিনি স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে স্থগিত হয়ে যাওয়া  পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নির্মাণ করা হবে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশগুলোয়, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেবাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ মার্চ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন উৎসব সপ্তাহের উদ্বোধনকালে বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দেশকে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এর থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় দেশ গড়ায় বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

বিজ্ঞান কারিগরি জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির সম্মেলন উপলক্ষে এক বাণীতে তিনি বলেছিলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য বিজ্ঞান কারিগরি জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো দরকার। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ব্যাপারে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবেন। প্রকৌশলী প্রযুক্তিবিদদের কাছে বঙ্গবন্ধুর অনেক প্রত্যাশা ছিল। ১৯৭৫ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী কর্মকর্তাদের এক যৌথ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যে কোনো দেশের শতকরা ৮০ ভাগ উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের প্রকৌশলী কারিগরদের উপর। স্থানীয় অবস্থার পটভূমিকায় সমস্যার সমাধান খোঁজার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রকৌশলী প্রযুক্তিবিদদের তিনি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ জরিপ, পরিবেশ, দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র উৎক্ষেপিত আর্থ রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইটের (ইআরটিএস) প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ ইআরটিএস নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায়  বাংলাদেশে পরবর্তীকালেবাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) তৈরি হয়। এছাড়া  বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সময় বেশ কিছু অর্ডার, অধ্যাদেশ আইন তৈরি করা হয়। যেমন- ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশন অর্ডার, বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদ অধ্যাদেশ, বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট আইন ইত্যাদি। এগুলো তৈরির মাধ্যমে দেশে নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরিসহ বিজ্ঞানের গবেষণার পথ প্রসারিত হয়।

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৫০০ কিমি বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন এবং দেশব্যাপী পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়।

সংবিধানের  ১৬ অনুচ্ছেদে পল্লী বিদ্যুতায়নের প্রতিশ্রুতি সন্নিবেশন করা হয়। তার কাজের মাঝে ছিল ঢাকার রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্থায়ী নতুন ভবন উদ্বোধন। সস্তায় রেডিও, টিভি দেওয়ার ব্যবস্থা করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মিগ বিমান, হেলিকপ্টার পরিবহন বিমান সংগ্রহ করা হয়। যুগোস্লাভিয়া থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রশস্ত্র সাঁজোয়া বাহিনীর জন্য ভারি অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। ৪০০ ধ্বংসপ্রাপ্ত  সাবস্টেশন পুনর্নির্মাণ করা হয়। খুলনা, রাজশাহী সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন পুনর্সংস্কার, টিএন্ডটি বোর্ড গঠন, জাতিসংঘের সহায়তায় কোটি ৩৫ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের পদক্ষেপ, নতুন শিক্ষাবোর্ড গঠনসহ তিনি অসংখ্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রযুক্তিগত কর্মকান্ডে আরও কিছু তথ্য দেওয়া যেতে পারে।বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদ জরিপ, পরিবেশ, দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র উৎক্ষেপিত আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইটের (ইআরটিএস) প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে ইআরটিএস নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষণা দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) তৈরি হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি আধুনিকায়নে পানি যন্ত্র সরবরাহের ফলে ১৯৭১-৭২ সালের ২৫,৮৭,৩০০ একর আবাদি জমি ১৯৭৪-৭৫- ৩৫,৬১,৪৭২ একরে উন্নীত করেন, অর্থাৎ কৃষি খাতে প্রযুক্তিগত প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কৃষি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরকে তিনি পরিপূরক খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

তিনি মিল-কারখানা জাতীয়করণের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরের সম্প্রসারণ শুরু করেন। এর ফলে স্বাধীনতার প্রথম বছরে পাট, বস্ত্র, কাগজ এবং সার কারখানা যথাক্রমে ৫৬, ৬০, ৬৯ এবং ৬২ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা ধারণ করে, যা স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ছিল। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৪-৭৫ বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৫ লাখ টাকা থেকে কোটিতে উন্নীত করেন, যেখানে নতুন শিল্প স্থাপনের বিধান রাখা হয়। (https://www.alokitobangladesh.com/print-edition/editorial/)

) আজীবন বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করা মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫২ সালে যেমনি চীনের আন্তর্জাতিক শান্তি সম্প্রসারণে বাংলায় ভাষণ দেন, তেমনি ৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রচলনের জন্য দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন। বঙ্গবন্ধুর একটি অমর কীর্তি হচ্ছে বাংলা টাইপরাইটার প্রবর্তন করা। তিনি ১৯৭২ সালে শহীদ মুনীর চৌধুরী আবিষ্কৃত মুনীর কিবোর্ডের ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব জার্মানি বা গণতান্ত্রিক জার্মান প্রজাতন্ত্রের অপটিমা কোম্পানির সঙ্গে মিলে অপটিমা মুনীর বাংলা টাইপরাইটার প্রবর্তন করেন, যা বাংলা একাডেমি বাজারজাত করে। এর আগে পঞ্চানন কর্মকার ১৭৭৮ সালে ছেনিকাটা শিশার বাংলা হরপ তৈরি করেন। পশ্চাৎপদ বাংলা ভাষাকে যন্ত্রে ব্যবহার করার এই সক্ষমতা অর্জনকে প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা প্রয়োগের একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখতে হবে। এই টাইপরাইটারের ভিত্তিতেই ৮৭ সালের ১৬ মে প্রথম বাংলা কিবোর্ড জব্বার তৈরি হয় কম্পিউটারে কম্পোজ করা প্রথম বাংলা পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশিত হয়। পরে বিজয় অন্যান্য কিবোর্ড এসে তার জায়গা দখল করতে থাকে।

খুব সঙ্গতকারণেই আমরা বঙ্গবন্ধুর আরও যেসব কাজ আছে সেগুলো এখানে তুলে ধরিনি। তবে আমি মনে করি অতি সংক্ষেপে যে কয়টি কাজের কথা আমি এখানে উল্লেখ করেছি তাতে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটাই কেবল তিনি দেখেননি, তিনি কেবল সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নটাও দেখেননি, আমরা আজকে যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় মানবিক ডিজিটাল যুগের কথা বলছি তার বীজ বঙ্গবন্ধুর বপন করা বীজ থেকেই অঙ্কুরিত। আমরা আজকাল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে একটি ডিজিটাল সাম্য সমাজ গড়ার কথা বলি। এই সাম্য সমাজটির কথা ভাবতেও বঙ্গবন্ধুর কৃষি সংস্কার এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা ভাবতে হবে। তিনিই সমাজটাকে কেবল ডিজিটাল নয়, সাম্য সমাজ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আমরা গর্বিত যে, জাতির পিতার নীতি আদর্শ অনুসরণ করে তাঁর সোনার বাংলা গড়ছি এবং তাঁর রোপিত ডিজিটাল বাংলাদেশ সেই সোনার বাংলা বা ডিজিটাল সাম্য সমাজ গড়ার হাতিয়ার। জয় বাংলা।   (সমাপ্ত)

ঢাকা২৫ মার্চ ২০২৩

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম

 ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রণেতা

[email protected]

www.bijoyekushe.net

×