ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ সরকার ও নির্বাচন

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ সরকার ও নির্বাচন

জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ

মানুষের বিশ্বাস ও আদর্শের লালন-পালন দীর্ঘদিনের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। এটি যেমন করে হুট করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, ঠিক তেমনিভাবে হুট করে পরিবর্তনও হয় না। জঙ্গিদের ক্ষেত্রে তথা জঙ্গিদের কার্যক্রমের মধ্যে এ বিষয়টির ব্যুৎপত্তি খুব ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অনেকের মধ্যে ধারণা রয়েছে এমন, যে সব জঙ্গি বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে জেল হতে বেরিয়ে এসেছে কিংবা জামিনে মুক্ত রয়েছে তাদের পুনরায় জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

অর্থাৎ জঙ্গিবাদে তারা সংযুক্ত হবেন না। বিষয়টা কোনোভাবেই সঠিক নয়। কেননা জঙ্গিরা যে সদলবলে একত্রিত হয়ে পুনরায় সংঘটিত হচ্ছে তার সাম্প্রতিক নমুনা দেখা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে জঙ্গিরা একত্রিত হয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে। ব্যাপকভাবে আক্রমণের প্রস্তুতিও গ্রহণ করছে। পাহাড় তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হওয়ায় জঙ্গিরা তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ের দুর্গম এলাকাকে বেছে নিয়েছে। পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে জঙ্গিদের একটি চুক্তিও হয়েছে। আগে নিষিদ্ধ পুরনো জঙ্গিদের সঙ্গে পথভ্রষ্ট তরুণরা সংযুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি করছে। 
জঙ্গিরা সাধারণত তাদের আক্রমণের জন্য বিশেষ বিশেষ সময়কে বেছে নিয়ে থাকে। যে সব জঙ্গি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে তারা ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে মর্মে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আরও জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, বোমা তৈরিসহ পাঁচ ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গিরা। পাহাড়ের গহীন অরণ্যে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বম সম্প্রদায়ের চার প্রশিক্ষক।

তাদের সহায়তা করছে বম সম্প্রদায়ের আরও দুজন। জঙ্গিরা তাদের এ নতুন প্রজেক্টকে সামনে রেখে নতুন সদস্য যেমনভাবে সংগ্রহ করেছে, পাশাপাশি পুরনোদের সুসংগঠিত করে দলের শক্তি ও পরিধি বৃদ্ধি করেছে। করোনাকালীন সময়েও জঙ্গিরা বসে থাকেনি। তারা তাদের মধ্যকার শক্তি বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে। পার্বত্য এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ সদস্যরা চুক্তির বিনিময়ে গ্রুপটিকে প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিয়েছে।

বিনিময়ে জঙ্গি গ্রুপটি মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা প্রদানের পাশাপাশি কেএনএফ এর ১৫০ সদস্যদের খাবার খরচ প্রদান করছে। সরকারের উচিত হবে আরও তদন্তের মাধ্যমে এ ধরনের গ্রুপগুলোর সঙ্গে যে বা যাদেরই সংযুক্ততা থাকুক না কেন, প্রত্যেককে খুঁজে বের করে জনগণের সামনে মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া এবং বিচারের মুখোমুখি করা। 
দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে চারজন প্রশিক্ষক লালমোহন রিয়াল ওরফে কর্নেল সলোমান, ভাঙচুর লিয়ান, লালমুন সাং বম ওরফে পাদন ও দিদার ওরফে চম্পাই। প্রশিক্ষণে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহসহ সার্বিক নেতৃত্ব দিচ্ছে বম সম্প্রদায়ের নাথানা লনচে ওরফে নাথান। অস্ত্র চালানো, বোমা তৈরি ছাড়াও চোরাগোপ্তা হামলা, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার বিভিন্ন কৌশলসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় ক্যাম্পে।

পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সদস্যরা অর্থের বিনিময়ে তাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্বোক্ত বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখপূর্বক সামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করেছে দুপক্ষই। যদিও বাস্তবে সেসবের কোনো ভিত্তি নেই। তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে বিভিন্নভাবে মগজধোলাই করা হয়। তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউসে রেখে শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকায় কেএনএফের প্রশিক্ষণ শিবিরে ৪১ জনের বেশি প্রশিক্ষণরত জঙ্গির নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া নামের জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান পাওয়া গেছে। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া প্রায় চার বছর ধরে গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। নতুন সদস্য সংগ্রহ করে চরাঞ্চল ও পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল তারা। এ সংগঠনের লক্ষ্য ছিল দেশব্যাপী সশস্ত্র হামলা চালানো। 
এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ কখনোই জঙ্গিবাদের হুমকির বাইরে ছিল না। জঙ্গিবাদ যে কোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং সারাদেশের মানুষের আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। হলি আর্টিজানের হামলার পরে তেমন উল্লেখ্য হামলা করতে পারেনি জঙ্গিরা। জঙ্গিদের প্রস্তুতিপূর্বক তথ্য জেনে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে জন্যই জঙ্গিরা ডালপালা মেলে সক্রিয়ভাবে দাঁড়াতে পারছে না।

তবে তাদের শেকড় কিন্তু রয়েছে। সে বিষয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। সরকার যেভাবে জঙ্গিবাদকে প্রতিকারে সফল, প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকারের আরও প্রোঅ্যাকটিভ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে  সরকার জঙ্গিবাদকে কখনোই আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় না। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে জন্যই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিরাপদে-নির্বিঘ্নে, স্বস্তির সঙ্গে জঙ্গিবাদের আতঙ্ক অতিক্রম করে বাস করছে। তবে গ্রামে-গঞ্জে কিংবা শহর-সিটিতে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকারী ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অ্যাকশন গ্রহণের নমুনা তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, যেমনটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সশস্ত্র জঙ্গিবাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে। 
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম একটি বিষয় হলো-জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করা। সে বিষয়টি সরকার যথার্থভাবে পালন করার চেষ্টা করছে। তবে সার্বিকভাবে দেশব্যাপী যাদেরকে টার্গেট করে জঙ্গিরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করে, তাদেরকে যাতে কোনোভাবেই টার্গেট করতে না পারে- সে সংক্রান্তে সমাজ বিনির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যে সব রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল জঙ্গিদের কোনো না কোনোভাবে প্রমোট করে, তাদের চিহ্নিত করে সমাজ থেকে বয়কট করতে হবে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট দলসমূহকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ইতোপূর্বে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক রাজনৈতিক দলকে সরকার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো কোনো না কোনোভাবে সমর্থন প্রদান করছে। কিংবা নিষিদ্ধ দলগুলোর কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলে অনুপ্রবেশ করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে কারণেই এসব গোষ্ঠীকে সদলবলে চিহ্নিত করে পরিচয় প্রকাশ করা উচিত।

যাতে করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা এবং তাদের অভিভাবকদের এদের সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে। মনোজাগতিক বিকাশ তথা সুকুমার বৃত্তির মানসে সরকারকে কাজ করতে হবে। শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অগ্রগামী প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হবে। বিনষ্ট হয়ে যাবে দেশের ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টারা। 
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে জঙ্গিবাদের রাজনীতি যেন একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিচ্ছেদ্য এই কারণেই যে, একটি অংশ সবসময়ই জঙ্গিদের লালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। হলফ করে বলা যায়, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত কখনোই জঙ্গিরা আস্ফালন দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এ দিকে আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। দলটি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী।

তারই ধারাবাহিকতায় সকল ধরনের অপশক্তিকে দেশ হতে পরাহত করার দায়িত্বও সরকারের। সরকার জঙ্গিবাদের প্রতিকারে শতভাগ সফল। কেননা, সরকারের শাসনামলে অপশক্তি জঙ্গিবাদ ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে পারেনি। পারেনি জনসাধারণকে অস্থিরতায় নিপতিত করতে। পাশাপাশি জঙ্গিবাদের প্রতিরোধে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের অংশ হিসেবে আপামর জনসাধারণের সুকুমারবৃত্তির চর্চা অব্যাহত রাখার স্বার্থে সময়ে সময়ে উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

পুরো সমাজকে ঢেলে সাজানোর তাগিদ থেকে স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে অপশক্তি নিপাতে কাজ করা প্রয়োজন। না হলে কালো আঁধারে ঢেকে যেতে পারে পুরো সমাজ। অন্ধকারকে পদদলিত করে সত্যের পথে আলোর সন্ধানে বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রায়ই পারবে জঙ্গিবাদের মতো ভয়ংকর অপশক্তি সমাজ হতে চিরতরে ধূলিসাৎ করতে। 
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সচরাচর দেখা যায়, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অপশক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাদের অবস্থান ও উপস্থিতি জানান দেওয়ার নিমিত্তে তারা বহুরূপ কৌশল অবলম্বন করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সময়ে পেশীশক্তির প্রভাব দেখানোর অপচেষ্টা করে থাকে অনেকেই বিশেষ করে গোপনে থাকা রাজনৈতিক শক্তিগুলো। এমতাবস্থায় আসন্ন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র নিষিদ্ধ ঘোষিত অপশক্তিগুলো একত্রিত হয়ে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।

সে বিবেচনায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে অপশক্তিকে মোকাবিলার স্বার্থে। অপশক্তিগুলো যদি কোনোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যেতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের জনজীবনে কালো আঁধার নেমে আসবে। ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হবে। মানুষের মধ্যে আতংক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির নমুনায়নের ফলশ্রুতিতে আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিশ্ব পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মুক্তিকামী জনতা বরাবরই এ ধরনের অপশক্তিকে মোকাবিলার নিমিত্তে তাদের সুচিন্তিত রায় প্রদান করেছে। ভবিষ্যতেও তাদের এ ধরনের রায় অব্যাহত থাকবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। 

লেখক : সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×