ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণ ॥ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি

ড. মুহম্মদ মনিরুল হক

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

স্মরণ ॥ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি

শেখ ফজলুল হক মণি

মুক্তিযুদ্ধের সকল পঙ্ক্তি, সকল পাতা, সকল অধ্যায়, সকল খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের নাম জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মুক্তিদর্শনের মহানায়কের নাম বঙ্গবন্ধু। সোনার বাংলা গড়ার পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব ও মতবাদের নাম মুজিববাদ। মুজিববাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চর্চিত, প্রচারিত রাজনৈতিক দর্শন ও মূল্যবোধের সমষ্টি। বঙ্গবন্ধুর পর শেখ ফজলুল হক মণি হলেন মুজিববাদের অন্যতম ধারক, বাহক, তাত্ত্বিক, প্রচারক ও নির্ভীক সংগঠক।
বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় রাজনীতিতে আসা এবং তাঁর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে রাজনৈতিক দীক্ষা পাওয়া শেখ ফজলুল হক মণি আমৃত্যু রাজনৈতিক শিক্ষক মুজিবের দর্শন বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন। শেখ মণি পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন (১৯৬০-৬৩) ২৩ বছর বয়সে। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র।

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন আন্দোলনে। ১৯৬৪ সালে গভর্নর কুখ্যাত মোনায়েম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান। পাকিস্তান সরকার বারবার কারারুদ্ধ করেও তাকে দমাতে পারেনি। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মণি জেল হাসপাতাল থেকেই ল’ পরীক্ষা দিতেছে, ভালোই দিয়েছে খবর পেলাম।’  
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম যেত পিছিয়ে। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারাবন্দি। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের সংগঠিত করে হরতাল সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ আটটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেও শেখ মণিকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। জেলে বসে (কারাগারের রোজনামচা) বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৬ দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে।...আমার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।’
১৯৭০ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম মাইলফলক। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়ন, প্রচার-প্রচারণা ও জয়লাভের অন্যতম কারিগর বলা হয় শেখ মণিকে। একাত্তরের ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে সবাই যখন কি করতে হবে সেই চিন্তায় দিশেহারা, তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি গড়ে তুলেছিলেন মুজিববাহিনী।

মুজিববাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর দর্শনের আলোকে একটি শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।  বাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।

শেখ ফজলুল হক মণির মৌলিকত্ব হলো, তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পাশাপাশি এমন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা মুজিববাদের অন্যতম লক্ষ্য। তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক, তাত্ত্বিক ও সম্পাদক। ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ তার ঐতিহাসিক সম্পাদনা। তার গল্প সংকলন ‘বৃত্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘অবাঞ্ছিতা’ টেলিফিল্ম।

১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’ প্রকাশ করেন তিনি। তার উদ্যোগ ও সম্পাদনায় ১৯৭৩ সালে ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’ ও ১৯৭৪ সালে ইংরেজি দৈনিক ‘বাংলাদেশ টাইমস’ প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে নিয়মিত কলাম লিখতেন। স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলার বাণীতে প্রকাশিত তার কলাম ‘দূরবীণে দূরদর্শী’ শুধু রাজনীতি বিশ্লেষণের ঐতিহাসিক দলিল নয়, মুজিববাদেরও তত্ত্বীয় রূপ।
শেখ ফজলুল হক মণি রাজনীতিতে। মুজিবীয় আদর্শে মুক্তির পথ দেখাতে গিয়ে অনেক ক্ষমতাবানদেরও বিরাগভাজন হয়েছেন। সুবিধাবাদী ও মুখোশধারী রাজনীতিকদের তিনি চরমভাবে ঘৃণা করতেন। অপ্রিয় হলেও তিনি সত্য ও স্পষ্টকথা বলতেন। তিনি চেয়েছিলেন গতানুগতিক ও ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির আমলাতন্ত্রের সংস্কার করতে। ৩০ নভেম্বর ১৯৭৪ সালে এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘সাবোটাজকারীরা ক্ষমতার আশপাশে এমনই সুকৌশলে ও সুসজ্জিতভাবে জমজমাট বসিয়া রহিয়াছে যে, সাহায্য করিতে গেলেও দ- ভোগ করিতে হইবে।’
শেখ ফজলুল হক মণির আদর্শ ও সংগ্রামের মূল প্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও তাকে স্নেহ করতেন। মুজিববাদ বা মুজিববাদী দর্শনের প্রয়োজনীয়তা তার মতো কেউ অনুধাবন করেননি। মুজিববাদী মতবাদ বাস্তবায়নে তার মতো কেউ উদ্যোগ নেননি। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারেননি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার কিছু আগে ধানম-ির বাসায় গিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করে খুনি ঘাতক চক্র। আরজু মণির ভাই, বোন ও পিতাকেও সে রাতে নির্মমভাবে হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারী দল। ভাগ্যগুণে প্রাণে বেঁচেছিলেন দুই শিশু পরশ ও তাপস। খুনি হায়েনাও দল ও তাদের দোসরদের হত্যা, লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে কখনো আত্মীয়ের বাসায়, কখনো পলাতক থেকে, কখনো অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়ে বড় হয়েছেন শেখ মণির দু’সন্তান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।

মাত্র ছত্রিশ বছর (জন্ম ৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯) বয়সে ঘাতকরা শেখ ফজলুল হক মণির জীবন কেড়ে নিলেও ছোট জীবনে তিনি আমাদের অনেক দিয়েছেন। ছয় দফা আন্দোলনে, অসহযোগিতার সংগ্রামে, ’৭০-এর নির্বাচনে, মুক্তিযুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনীতি, শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ ও ‘সোনার বাংলা’ গঠনে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার জীবনকাহিনী, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গ্রন্থ এবং দেশপ্রেমের সাহসী রাজনীতি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বরূপ, মুজিববাদের পরিপূরক এবং ‘সোনার মানুষ’ তৈরির অনন্য পথ নির্দেশক।

লেখক : শিক্ষা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ

 

×