ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

প্রাপ্তিতে ভরে থাকা প্রবাস জীবন

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২৮ নভেম্বর ২০২২

প্রাপ্তিতে ভরে থাকা প্রবাস জীবন

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনি একটি নয়নাভিরাম সুন্দর নগরী। এর মূল আকর্ষণের একটি হচ্ছে বিচ । সমুদ্র সৈকত নামে পরিচিত এই বিচগুলো পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা পূরণ করে। নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন মানুষের সংখ্যাও অজস্র। তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে শীতকাল চলে এদেশে। সিডনি শীত থেকে বের হলেই শুরু হয় বসন্তকাল। মূলত তখনই সামার বা গ্রীষ্মের শুরু। শুরুর সময় থেকে শেষ পর্যন্ত সি বিচ মানেই মানুষের কাছে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ অবগাহন। কতবার যে যাই বা গেছি তার কোন হিসাব নেই। বাচ্চা থেকে বয়ঃবৃদ্ধ সবাই শামিল এই কাতারে। কেবল সমুদ্র দর্শন বা স্নান করার জন্য যে মানুষ যায় তা নয়। এর বাইরেও কতকিছু ঘটে। যখন এ লেখা লিখছি তার একদিন আগে এখানকার বিখ্যাত বন্ডাই বিচে হয়ে গেল অভিনব এক ঘটনা। শরীরের ত্বকের ক্যান্সার রৌদ্রময় দেশের এক অনিবার্য বাস্তবতা।

এ দেশে এসে দেখেছি হাজার হাজার মানুষ স্কিন ক্যান্সার- ত্বক ও চামড়ার ক্যান্সারে ভোগেন। যারা অস্ট্রেলিয়া নিয়ে ভাবেন বা জানেন তাদের অজানা নয়, এ দেশের আদিবাসীরা সব সময় সাদা চন্দনের মতো কিছু মুখে ও কপালে ঘষে রাখেন। তাদের এবরজিনাল নামে ডাকা হয়। এসব ভূমি সন্তানরা এমনি এমনি এমন কিছু ঘষতেন না বা ঘষেন না । তারা মূলত যেসব এলাকায় বা রাজ্যে বসবাস করেন তার পুরোটাই উত্তপ্ত বনভূমি বা মরুভূমি। কোথাও কোথাও গরমের জ্বালায় টেকা দায়। তীব্র গরম আর রোদের আঁচ থেকে বাঁচতে তারা সফেদ প্রলেপ লাগান কপালে-শরীরে। এই প্রাকৃতিক সুরক্ষার বদলে মানুষ এখন ব্যবহার করে সান ক্রিম। রোদ এবং ক্যান্সার থেকে বাঁচার জন্য কত যে ক্রিম কত যে প্রডাক্ট এ দেশে না এলে জানাই হতো না। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বন্ডাই বিচ স্কিন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ঘটাল এক নতুন ঘটনা।

বিচে সমবেত ক্যান্সার প্রতিরোধে এগিয়ে আসা সবাই ছিলেন নগ্ন। শরীরের সবকিছু প্রকাশ্য করে দিয়ে সমবেত মানুষের এই ঘটনা এ দেশে নতুন। পৃথিবীর বহু দেশে এমন ঘটে। আমাদের সমাজে এমন কিছু ভাবাও পাপ। কিন্তু ভাবার অনুরোধ জানাই কতটা স্বাধীনতা থাকলে বা কতটা উদার হলে একটি সমাজ এমন ঘটনা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে। সত্যি বলতে কি নগ্নতার প্রতি খোলামেলা সমর্থন না থাকলেও বলব, সবকিছুতে গেল গেল রব তোলা আমরা আসলেই কূপম-ূক। আমাদের এই পশ্চাৎপদতা কবে দূর হবে কে জানে?
সিডনিতে ফুটবল বিশ্বকাপের জোয়ার কেমন? এ কথা অনেকেই জানতে চান। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া যেখানে খেলছে মূল পর্বে। শুধু খেলছে বলা যাবে না, গত খেলায় তিউনিসিয়াকে কুপোকাত করতেও ছাড়েনি। কিভাবে সম্ভব হলো? মাত্র দুই কোটির কিছু বেশি মানুষের দেশ এটি। অথচ বিস্তীর্ণ নগর-বন্দরে মাঠের পর মাঠ পড়ে আছে, যেগুলো ফুটবল খেলার জন্য তৈরি। মাঝে মাঝে মনে হতো এত ফাঁকা মাঠের কি দরকার? রাতে ট্রেনে গাড়িতে যেভাবেই ভ্রমণ করেন না কেন চোখে পড়বে আলো ঝলমল গোলপোস্টের মাঠে অদম্য কিছু তরুণ খেলেই চলেছে।

ভাবতাম, দিনে দুপুরে বা রাতে কারা এরা? কেন এভাবে প্রাকটিস করছে? এখন নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর দরকার নেই যে, এখান থেকেই শুরু হয় পথ চলা। যারা খেলা দেখেন তাদের অজানা নয় একদা সাদা মানুষের কট্টর দেশ নামে পরিচিত অস্ট্রেলিয়ার দলে কালো ছিপছিপে এক খেলোয়াড় খেলছে মূলপর্বে। মাত্র ষোলো সতেরো বছর বয়সের এই তরুণ নিশ্চিত ভাবেই অন্য দেশ থেকে আগত কোনো অভিবাসী। শরণার্থী হয়ে আসা এই যুবক এখন মূল জায়গায় ঠাঁই করে নিয়েছে আপন যোগ্যতায়। আপনি এ দেশে এলেই টের পাবেন বহুজাতিকতার সুফল কি। এই যুবকের মতো অনেকেই এশিয়া আফ্রিকা বা অন্য দেশে ফুটবল খেলে খেলে বড় হতে চায়। কিন্তু জনসংখ্যায় গিজ গিজ করা সমাজে তাদের সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে পড়ে অঙ্কুুরেই। ফুল আর ফুটতে পারে না।

নিশ্চিত এমন অতুল প্রতিভার অধিকারী অনেক তরুণকে ডাক পাঠাবে এদেশ। অচিরেই ভালোভাবে থাকা আর নিজেকে তুলে ধরার জন্য এমন দেশে পাড়ি জমাবে তারা। সেখান থেকেই গড়ে উঠবে অদম্য আরেক অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল দল। যারা একসময় ফাইনালে খেললেও অবাক হব না। সবচেয়ে বড় কথা, উত্তেজনা পরিমিত। আনন্দ আপন বলয়ে রাখা সমাজ জানে কখন কিভাবে এগোতে হয়। আমরা জানি না মানিও না তাই অন্য দেশের নামে মাতোয়ারা হয়ে নিজেরা নিজেরা করি মারামারি।
সম্প্রতি নিউ সাউথ ওয়েলস তথা সিডনি পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রশংসা প্রস্তাব তুলে ধরে খবরের শিরোনামে এসেছেন বাংলাদেশ হিতৈষী নামে পরিচিত পার্লামেন্টারিয়ান শওকত। ভদ্রলোক আমাদের উপমহাদেশের সবগুলো দেশের জন্য কাজ করেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ নেপালসহ কয়েকটি দেশে গিয়েছিলেন বিনামূল্যে হুইল চেয়ার বিতরণের জন্য। ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। এ দেশে প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত মাল্টিকালচারাল ও আদিবাসী পদকে কলাম লেখক হিসেবে আমাকে পুরস্কত করার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।

এসবের পেছনে নিশ্চয়ই বাংলাদেশীরাও থাকেন। যাদের কাজ ও কর্মের সাধনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন গঠনমূলক উন্নয়নমুখী কাজের জন্য এই প্রস্তাবে এখানকার অগ্রজ নেতা সমাজকর্মী গামা আবদুল কাদেরের নামও এসেছে। দীর্ঘকাল ধরে তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য কাজ করছেন। সবাই মনে করেন এ হচ্ছে কাজের ফসল। যারা কাজ করেন তারা একটা না একটা সময় প্রশংসিত হবেন বা প্রাপ্য পাবেন, এটাই নিয়ম। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় বাংলাদেশীরা প্রবাসে এভাবেই তাদের দিন গুজরান করেন। তাদের বুকে থাকে স্বদেশ। ধ্যানে-জ্ঞানে মাতৃভূমি আর কর্মে উজ্জ্বল প্রবাস জীবন।

×