ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:২৮, ৫ অক্টোবর ২০২২

শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন

তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার একটি বড় কারণ

বিগত ৩-৪ বছর যাবত এত বেশি শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে- আত্মহত্যা এবং দুর্ঘটনায়, যা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এত বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের মতো বড় জনসংখ্যার দেশে শিক্ষা গ্রহণরত কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। যা জাতির জন্য ভয়ানক উদ্বেগজনক।
বাঙালী সমাজে কতগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়-
* প্রথমত বাঙালী মুসলিম সমাজে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে নিরক্ষর বা অল্পশিক্ষিত পুরুষদের মধ্যে কন্যাশিশুর প্রতি অনীহা, অপছন্দ, এমনকি নিজ সন্তানকে হত্যা করতেও দেখা যাচ্ছে, যা আগে দেখা যায়নি। দেখা গেছে, পিতা দ্বিতীয় কন্যা হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে মাত্র ষোলো মাসের শিশুকন্যাকে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে হত্যা করে চরম বর্বর আচরণ করেছে, যা অদৃষ্টপূর্ব! আমি আগে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালে শিক্ষকদের সন্তান জন্মের ঢ এবং ণ- ক্রোমোজমের ভূমিকার ওপর পাঠ দিয়ে তাদের সচেতন করতে ঐ পাঠ অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। এ পদক্ষেপ তখনকার শিক্ষাবিদদের প্রশংসা লাভ করেছিল। শিক্ষক সমাজ পরিবর্তনের বাহক। তারা জনমানুষকে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দেবেন এবং সমাজ কুসংস্কার মুক্ত হবে।
* দ্বিতীয়ত, পুরুষদের মধ্যে মাদক সেবনের সংখ্যা বৃদ্ধি বধূ হত্যার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। মাদকের জন্য জমি বিক্রি এবং নববধূর বাবার কাছ থেকে যৌতুকের দাবিতে অসহিষ্ণু স্বামী নববধূকে হত্যা করছে! যৌতুকের দাবি বধূর শ্বশুর, শাশুড়ি ও অন্য আত্মীয়স্বজনও করে থাকে, যা আইন করেও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। যৌতুক গ্রহণ যে একটি লজ্জার বিষয়, সে সম্পর্কে সচেতনতাও তৈরি হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে সমাজ, সমাজের শিক্ষিত তরুণ-তরুণী সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত সমাজদেহ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় উৎস- যৌতুক প্রথা বন্ধ হবে না।
* তৃতীয়ত, শিশু-কিশোরী কন্যা থেকে শুরু করে তরুণী-এমনকি প্রৌঢ়া নারী পর্যন্ত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, সম্ভ্রমহানির শিকার হচ্ছে নিয়মিত! ধর্ষণ বর্তমানে আমাদের দেশে একটি বড় মাপের সামাজিক অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।
* চতুর্থত, কিশোরদের মধ্যে গ্যাং প্রথার জন্য দেখা যাচ্ছে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে ছুরি মেরে হত্যা করছে এবং এতে তারা মোটেও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ করে না! বন্ধু-সঙ্গীদের মধ্যে আত্মিক কোন টান ও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যার ফলে মানুষ অমানবিক ও অমানুষ হয়ে উঠছে। এরাও অধিকাংশ সঙ্গীদের দ্বারা মাদকাসক্ত, যারা মাদকের প্রভাবে মানবিক সব গুণাবলী হারিয়ে ফেলেছে। এদের কাছে মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধুর প্রতি স্বাভাবিক প্রীতি-ভালবাসা হারিয়ে ফেলে এরা একটা অর্থহীন, পরিবার ও সমাজের বাইরে গিয়ে প্রান্তিক মানুষে পরিণত হচ্ছে। যা আমাদের এক চরম ব্যর্থতা।
* পঞ্চমত, দৈনিক পথ-দুর্ঘটনা আমাদের নিজ পরিবারের আশার, স্বপ্নের ভবিষ্যত গঠনের বর্তমান কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীদের অমূল্য প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে প্রতিদিন! প্রতিদিন রিক্সা, সিএনজি, রাস্তা পারাপারে, মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়া বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চালকের অদক্ষতা ও অন্যের প্রাণের প্রতি নির্মম উদাসীনতার কারণে বিশাল একটি শিক্ষার্থী গোষ্ঠী, যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজের, পরিবারের এবং দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গঠন করতে পারত তারা অসময়ে ঝড়ে পড়ছে! এর চাইতে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে!
* ষষ্ঠত, আত্মহত্যা! কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর মধ্যে অতি দ্রুত আত্মহত্যার ঘটনায় অপমৃত্যুর সংখ্যা বর্তমানে অনেক উর্ধমুখী, যা আগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নগণ্য ঘটনা ছিল।
আমরা সবাই জানি, কৈশোর-যৌবনে নারী-পুরুষের আবেগ থাকে তীব্র। আবেগের চাপে এই বয়সীদের বিপ্লবের ডাক দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদ এমনকি জঙ্গিত্ব গ্রহণ করতেও দেখা যায়, যা নিজের ও পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনে। যারা তাদের ভুল বুঝতে সক্ষম হবে যৌবন উত্তীর্ণ হলে- এটি বিশ্বাস করি। এখন দেখি, ছোটখাটো পারিবারিক ঘটনায়, কোন জিনিস যেমন মোবাইল ফোন বা কোন ড্রেস না পেলেও ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যা করছে! এটি বর্তমান যুগে ভোগ-বিলাসের নানা দেশী-বিদেশী  ভোগ্যপণ্যের বাজার ভরে যাওয়া এবং বিশেষত, বন্ধু-প্রতিবেশী কারও ঐ জিনিস থাকা ও নিজের না থাকাকে সম্মানহানির, অমর্যাদার কারণ গণ্য করার ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দুঃখজনক।
তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার একটি বড় কারণ- প্রেম ভেঙ্গে যাওয়া, প্রেমিক-প্রেমিকার কারো দিক থেকে সম্ভবত, অপর কাউকে বেছে নেয়া তরুণ-তরুণীর পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন হয়ে ওঠে। এ সময়ে কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী তাদেরকে সঙ্গ দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের অসীম সম্ভাবনার কথা বলে, ভালো কোন গল্পের বই পড়তে দিয়ে, নিজেদের বন্ধু-বান্ধবীর গ্রুপে হাসি-আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে, দূরে কোথাও দু’একদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে এসব প্রেম-ঘটিত বেদনার আঘাতকে হাল্কা করে দেয়া সম্ভব। মা, বাবা, ভাই-বোন তাদের ক্ষোভ-দুঃখ- বেদনা কমিয়ে দিতে কোন প্রিয়জনকে, দাদি, নানি, নানা, দাদাকে আনিয়ে নানা হাস্য কৌতুক করে, গান শুনিয়ে, খেলাধুলা করে বাড়ির পরিবেশকে বদলাতে পারে।

পরিবেশ বদলে দিতে পারলে তরুণ-তরুণীর ঐ মুহূর্তে নেয়া আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পরে ঐ সিদ্ধান্তকে ভুল বলে গণ্য করতে পারবে। মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যার সময় ব্যক্তি নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ভাই, বোনদের নজরে পড়তে পারে। আত্মহননমুখী তরুণ-তরুণীকে রক্ষা করা তাদেরও দায়িত্ব- এটি ভুলে গেলে চলবে না। ‘যাকে এত ভালবাসি, সে আমাকে ছেড়ে যেতে পারল’- তরুণ মনে এ আঘাত কিন্তু বিশাল একটি আঘাত! চলমান জীবনে আরও অনেকে আসবে, তাদের মধ্যে অনেকে চলে যাবে, কেউ কেউ থাকবে, যাকে চাই, সে অন্য কাউকে চাইতে পারে- এটি ভয়ানক কিন্তু সত্য।

এ সত্যকে মেনে নিয়ে জীবনের হিসাব মেলাতে প্রত্যেক শিশু থেকে তরুণ-বৃদ্ধ সবাইকে ভিন্ন ভিন্নভাবে নানা উপায় অবলম্বন করে কঠিন, জটিল হিসাব মিলিয়ে পথ চলতে হয়। অনেকে বলে- কেউ হারে, কেউ জেতে। আমি বলি- কেউ হারে না। কোন না কোনভাবে সবাই কোন এক সময় জেতে। শুধু অর্থ আয় বা চাকরি লাভ করলে ব্যক্তি জিতবে, না করলে ব্যক্তি হারবে- বিষয়টা এমন নয়। চাকরি না পেয়ে স্বউদ্যোগী, চিত্রকলা, সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র চর্চা করেও মানুষ সফল হয়। একজন কৃষক বা জেলে বা কুমোর, তাঁতি কি কম সফল ব্যক্তি?
এবার আসি নৌদুর্ঘটনার প্রসঙ্গে। এই সেদিন পঞ্চগড়ে নৌ-দুর্ঘটনায় যাত্রী আধিক্যের কারণে প্রায় আশির মতো নারী, পুরুষ, শিশু এবং কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হলো। যে নৌকার ক্ষমতা ২০-২৫ যাত্রী, সেটাতে কিভাবে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে নিজেদের মৃত্যু নিজেরাই টেনে আনল যাত্রীরা! প্রায় এক শ’ জনের মতো যাত্রী উঠেছিল, যাদের নিয়ে নির্বোধ মাঝিও প্রাণ হারাল! অথচ দুটো নৌকায় ভাগ করে উঠলে তাদের সবাই প্রাণে বেঁচে থাকত।

পানিতে তারা জীবনের ঝুঁকি নিল কেন বুঝতে পারি না। ঐ এলাকার সব গ্রামের সব পরিবার স্বজন হারিয়েছে।  যে দুর্ঘটনা অতি সহজেই সাধারণ জ্ঞান, যা গ্রামের মানুষের ভালই আছে জানি, সেটুকু ব্যবহার করলেই বুঝত ২৫ জনের স্থানে ৮০ জন কোনভাবেই নৌকা বহন করতে পারবে না। আরেকটি বিষয় এই নৌ দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- আমাদের নদী-খাল-পুকুর ভর্তি দেশে-গ্রামে নারী-পুরুষ পানিতে পড়েও সাঁতার কেটে অধিকাংশই যেখানে বেঁচে যেত, সেখানে এত মৃত্যু কেন? এটি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, গ্রামেও শহরের মতো ছেলে-মেয়েদের সম্ভবত সাঁতার শেখানো হয় না। সত্যিই কি তাই? আমাদের গ্রামে বড় হওয়ায় মা, বাবা, খালা, মামারা সাঁতারে ছিল পটু।

আমরা পরবর্তী প্রজন্ম-ছেলে-মেয়েরা শহরের বন্ধ বাথরুমে গোসলে অভ্যস্ত হয়ে, পুকুর-জলাশয় না পেয়ে সাঁতার শিখতে পারিনি। সেটা লজ্জার বিষয় বলে মনে করি। বিদেশে স্কুলে, বাড়িতে সচেতন শিক্ষিত মা-বাবা শিশুদের সাঁতার, সঙ্গীত, বাধ্যযন্ত্র শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে দিয়ে থাকে। সাঁতার, সঙ্গীত, যন্ত্র বাজানো- যে কোনটি আয়ত্ত করলে মানুষ হয় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে তার যে জিনিসটি প্রথম প্রয়োজন সেটি জ্ঞান নয়, বরং আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসী শিশু প্রয়োজনে সমাজে, পরিবারের যে কোন নতুন পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যেখানে প্রতিরোধ করতে হবে, সেটি বুঝে নিয়ে প্রতিরোধ করতে পারবে।

সর্বোপরি, সমস্যার সমাধানে সঠিক ও যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এজন্য শিশুকে নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীনতা ও সুযোগ দিতে হবে। দেখিয়ে দেয়া, করিয়ে দেয়া শিশুরা পরনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। স্মরণ রাখতে হবে- জীবনটা ব্যক্তির। ব্যক্তিকেই শেষ পর্যন্ত একাই জীবনের সব বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে নিজের জায়গা নিজেকে তৈরি করতে হবে। এজন্যই তো বলে- খরভব রং হড়ঃ ধ নবফ ড়ভ ৎড়ংবং। এ পথে কাঁটা থাকবেই। এ কথা শিশুর বাবা, মা, শিক্ষক এবং পরে শিশুকেও উপলদ্ধি করতে হবে অবশ্যই।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×