ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রেশম শিল্পের বিকাশে করণীয়

মোঃ আরাফাত রহমান

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

রেশম শিল্পের বিকাশে করণীয়

রেশম শিল্পের বিকাশে করণীয়

রেশম এক ধরনের প্রাকৃতিক প্রোটিন তন্তু, যার কয়েকটি ধরন বস্ত্রশিল্প বয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়। রেশমের সর্বাধিক পরিচিত ধরন বম্বিক্স মোরি নামের রেশম পোকার লার্ভার গুটি থেকে সংগ্রহ করা হয়। একেক ধরনের রেশম পোকার গুটি থেকে একেক ধরনের সুতা পাওয়া যায়। বিশেষ ব্যবস্থায় রেশম পোকা চাষের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে এই সুতা প্রস্তুত করা হয়। রেশম পোকার গুটি চাষের পদ্ধতিকে বলা হয় সেরিকালচার।
বাংলায় দীর্ঘদিন থেকে চার ধরনের রেশম তৈরি হয়ে আসছে- মালবেরি, এন্ডি, মুগা ও তসর। প্রথমটি তৈরি হয় বম্বিক্স বর্গের রেশম পোকার গুটি থেকে, যে পোকা মালবেরি বা তুঁত গাছের পাতা খায়। দ্বিতীয়টি তৈরি হয় ফিলোসেমিয়া বর্গের রেশম গুটি থেকে, যারা ক্যাস্টর গাছের পাতা খায়। তৃতীয়টি এ্যান্থেরিয়া আসমেনসিন বর্গের রেশম গুটি থেকে। যারা কুল, তেজপাতা ও কর্পূরের পাতা খায়। চতুর্থটি এ্যানথেরি বর্গভুক্ত রেশম গুটি থেকে। যারা পাতা খায় ওক গাছের। সচরাচর মালবেরি রেশম সবচেয়ে মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত।
বাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ শিল্প এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ হিসেবে রেশম তৈরি প্রক্রিয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছিল বহু শতক আগে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তেরো শতকে সুদূর ইতালিতে রেশম গাঙ্গেয় সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। বাংলায় রেশম উৎপাদনের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে দেখা যায়, গ্রামের গৃহস্থরা রেশম উৎপাদনের প্রথম তিনটি পর্যায় সম্পন্ন করে- মালবেরি বা তুঁত চাষ, রেশম গুটি লালন-পালন এবং সুতা কাটা। তারপর সেই সুতা নিকটবর্তী গ্রাম বা শহরের দক্ষ তাঁতিদের কাছে বিক্রয় করা হয় বিভিন্ন প্রকার রেশম বস্ত্র তৈরির জন্য।
বাংলায় এত বেশি রেশম উৎপাদিত হতো যে, তা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পর প্রচুর পরিমাণে রফতানি হতো বাইরে। এই সিল্কের বাজারই প্রথম ইউরোপীয় বণিকদের বাংলায় আসতে আকৃষ্ট করে। ছোট আকারে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে। পরিণতিতে ইউরোপীয় বণিক কোম্পানিগুলো বাংলার বস্ত্রশিল্পের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। ক্রমশ তারা বাংলার তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রভাবান্বিত করে। বস্ত্র রফতানির পরিবর্তে প্রসারণশীল বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী বস্ত্র তৈরির কাঁচামাল রফতানি শুরু করে।

১৮৩৫ সালের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎপরতা এ অঞ্চলের একশ’টি রেশম নিষ্কাশন কেন্দ্রকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। এরপর থেকে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো রেশমের কাঁচামাল বাণিজ্যকে ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণ করে। রেশমের রফতানি বাণিজ্য অনেককাল জমজমাট থাকে। কিন্তু ১৮৭০-এর দশকে মহামারী আকারে রেশমকীটের রোগবিস্তার এবং কারিগরি দিক থেকে অচলাবস্থা সৃষ্টির দরুন বাংলার রেশম শিল্প বাজার হারায় বিদেশের।
বিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে বাংলার রেশম বস্ত্রের কদর কমে গিয়ে সেখানে কাশ্মীর ও মহীশূর সিল্কের চাহিদা তৈরি হয়। ১৯৩০ সালের মধ্যে চীন এবং জাপানের সিল্ক বাংলার রেশমের স্থান দখল করে। এমনকি বাংলায়ও এসব সিল্ক আসতে শুরু করে। এর ফলে বাংলায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দেখা দেয় চরম বিপর্যয়। সিল্ক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই বিপর্যয় বাংলার তৎকালীন সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
রেশম উৎপাদনে পাকিস্তান সরকারের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। রেশম শিল্পকে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে তোলার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু কোন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসেনি। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও কোন সংরক্ষণমূলক শুল্কনীতি ছিল না। সরকার রেশম উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির বিষয়ে অবাধ সুযোগ দেয়। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ রেশম শিল্পের উন্নয়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে ১৯৬২ সালের মধ্যে সরকারী অর্থায়নে রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরি চালু হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রেশম শিল্পের উন্নয়নের জন্য অধিকতর সুসংবদ্ধ নীতি গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও এই শিল্প বৈদেশিক সাহায্য এবং কারিগরি সহায়তা লাভ করে। ১৯৭৭ সালে সিল্ক খাতের কার্যক্রম সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতোমধ্যে কতিপয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রেশম উৎপাদনে এগিয়ে আসে। স্থানীয়ভাবে কিছু সাফল্য অর্জিত হলেও অধিকাংশ উদ্যোগই সম্মুখীন হয় নানা সমস্যার। সে সময় বাংলাদেশের রেশম উৎপাদনের পরিমাণ ভারতের সিল্ক উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক ছিল।
রেশম থেকে প্রথমে হ্যান্ডলুম কিংবা পাওয়ার লুমে থান কাপড় প্রস্তুত করা হয়। রেশম থেকে প্রস্তুত পোশাকের মধ্যে শাড়ি, কামিজ, থ্রি পিস, লেহেঙ্গা, ওড়না, শার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, স্কার্ফ, রুমাল, টাই, বেবি ওয়্যার ইত্যাদি অন্যতম। শাড়ি এবং অন্যান্য তৈরি পোশাকে বৈচিত্র্য আনার জন্য বিভিন্ন ধরনের নক্সা করা হয়। এ সকল নক্সায় রং, রঙিন সুতা, জরি, পুঁতি, কাঁচ, প্লাস্টিকসহ নানাবিধ উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
রেশমের ঐতিহ্যবাহী এবং অতি জনপ্রিয় শাড়ির নাম গরদ। রাজশাহী অঞ্চলে বোনা এই শাড়ি রেশমের স্বাভাবিক রঙের জমিনের বিপরীতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লাল বা সবুজ এবং কখনও সোনালি জরির কাজ করা পাড় থাকে। পাড়ে রেখা, ত্রিভুজ ও জ্যামিতিক আকার সমৃদ্ধ সূক্ষ্ম নক্সা থাকে। স্বাভাবিক রঙের রেশমি কাপড়ের নাম কোরা, ক্ষারি। ধোয়া হলে তার নাম হয় গরদ। গরদের শাড়ির পাড়ের রং যাই হোক না কেন, শাড়ির জমিন উজ্জ্বল বা হাতির দাঁতের বর্ণ হয়ে থাকে।
রেশমের তৈরি অপর একটি জনপ্রিয় শাড়ির নাম ঢাকার কাতান। ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারস থেকে আগত মোহাজেরগণ ঢাকা শহরের মালিটোলা, বেঁচারাম দেউড়ী, দক্ষিণ মৌসুন্ডি এবং লালমোহন সাহা স্ট্রিটে বেনারসি কাতান বয়ন আরম্ভ করে। পরে তারা মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে বসতি স্থাপন করে। কাতান বয়নে গর্ত তাঁত ব্যবহার করা হয়। এ তাঁতে শাড়ির নক্সা তোলার কাজে ব্যবহার করা হয় জ্যাকার্ড। রেশমি সুতা ও বুটির জন্য ব্যবহৃত হয় জরি। পাকান রেশমি সুতার নাম কাতান। বেনারসি শাড়িতে পাকান সুতা ব্যবহৃত হয় বলে এর অপর নাম কাতান শাড়ি।
রেশম উৎপাদন একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। রেশম গুটি থেকে রেশম তৈরি করা হয়। রেশম গুটি আসলে রেশম মথের শুঁয়োপোকা। এদের একমাত্র খাদ্য তুঁতপাতা। রেশমকীট ডিম থেকে জন্মায় এবং গুটিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর্যায় শেষ করে আবির্ভূত হয় রেশম মথ হিসেবে। স্ত্রী মথ তখন কালচক্র পুনরায় শুরু করার জন্য ডিম পাড়ে। গুটিবদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলোকে মেরে ফেলে সেগুলোকে সেদ্ধ করে সুতা ছাড়ানো হয় এবং পরে তা গোটানো হয়। এই সুতা বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তৈরির জন্য নানাভাবে প্রস্তুত করা হয়।
বাংলাদেশে প্রায় সবধরনের রেশমগুটিই গ্রামের হাটগুলোতে বাঁশের ট্রেতে করে প্রতিপালন করা হয়। রেশমগুটি পালন খুব পরিশ্রমসাপেক্ষ।

বিশেষ করে মৌসুমের শেষে যখন হাজার হাজার রেশমপোকা গোগ্রাসে পাতা খায়, তখন তাদের পালনের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমের প্রয়োজন হয়। রেশম রং করা, বোনা ও ছাপা প্রভৃতি কাজ গ্রামের ছোট কারখানা এবং শহরের উন্নত ফ্যাক্টরিতে সম্পন্ন হয়। বাংলায় যারা সিল্ক তৈরি করে, তাদের মধ্যে রেশমের ভিন্ন ধরনের নাম প্রচলিত আছে। যেমন- রেশমগুটি পালনকারীকে বলা হয় বোসনি, রেশমগুটিকে পোলু, গুটির সুপ্তাবস্থাকে চোঞ্চ বা বিজন গুটি, গুটি মেলার বাঁশের চালনকে বলে চন্দ্রোকি। রেশমকীটের মহামারী রোগকে কোটা রোগ এবং জীবাণু সংক্রামক মাছিকে বলা হয় উজি।
রেশমগুটি বা কোকুন দেখতে অনেকটা কবুতরের ডিমের ন্যায়। কোকুনের সুতা অবিন্যস্ত, কিন্তু ভেতরে ৫০০ মিটারেরও বেশি লম্বা একটি মাত্র সুতা সমকেন্দ্রীয়ভাবে বিন্যস্ত থাকে। কোকুন তৈরি হতে তিনদিন সময় লাগে। কোকুনের আকৃতি ও রঙে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ৮ দিনের মধ্যে গুটির ভেতর শুককীট পরিণত হয় পিউপায়। পিউপায় পরিণত হওয়ার আগেই কোকুন গরম পানিতে সিদ্ধ করে ভেতরের পোকাটি মেরে ফেলতে হয়।

এই কোকুন থেকেই রেশম সুতা সংগ্রহ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ পিউপা মথে পরিণত হয়ে গুটির প্রান্ত ফুটো করে যদি বের হয়ে আসে, তবে সুতার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় এবং রেশম সুতার গুণগতমান হ্রাস পায়। ২ থেকে ৬টি গুটির ভেতরের সুতা একত্রিত করে তৈরি করা হয় একটি রিল। বাইরের পরিত্যক্ত সুতাগুলো পাকিয়ে স্প্যান সিল্ক প্রস্তুত করা হয়, যার দ্বারা তৈরি হয় মটকা জাতীয় সিল্ক।
বাংলাদেশের রেশম বাজার পুরোপুরি স্থানীয়। কখনও কখনও স্থানীয় সরবরাহের বাইরেও রেশমের চাহিদা দেখা যায়।  বৈধ ও অবৈধ উপায়ে প্রধানত ভারত থেকে রেশমবস্ত্র আমদানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জীবনে রেশমের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। একখানি রেশম শাড়ির আভিজাত্য একটি দামী সুন্দর পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি। রেশম শাড়ি বিত্ত, সভ্যতা, বাঙালী রমণীর ঐতিহ্যগত সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের প্রতীক। সিল্কের বিভিন্ন নমুনা এবং ডিজাইনের জন্য বাংলা ভাষায় বিশেষ বিশেষ নাম প্রচলিত, যেমন গরদ, মটকা, বেনারসি প্রভৃতি।

লেখক : কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এ্যান্ড প্রফেশনাল  ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস,
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

×