ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

ড. এএইচএম মাহবুবুর রহমান

রাজনীতিতে প্রথম শর্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৬ মে ২০২১

রাজনীতিতে প্রথম শর্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ হয়েছিল। কারণ মুসলিম একটি ধর্মের অনুসারী। ইসলামী মূল্যবোধ যারা পোষণ করে তারাই কেবল এ রাজনৈতিক দল করতে পারবে, এটা হয় না। একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা সকল নাগরিকের থাকা উচিত। সে কারণেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহির্প্রকাশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। রাজনীতি আর ধর্ম এক নয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের এবং সকল প্রকার অন্যায় থেকে নিজ নিজ ধর্মের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ করা ধর্মের কাজ। ধর্মই একমাত্র মানুষকে পাপাচার থেকে নিবৃত করতে পারে। রাজনীতি তা পারে না। রাজনীতি কোন দলের প্রতি সমর্থন বা সেই দলের নীতি অনুসরণকে বোঝায়। রাজনীতিতে মিথ্যাচার থাকে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সুযোগ থাকে (ম্যাকিয়েভেলি ১৫১৩ )। ইহলৌকিক উন্নতি বা সফলতা লাভের জন্য রাজনীতি খুব সহজ পথ। ধর্মে এসবের সুযোগ নেই। তাহলে ধর্ম কেন রাজনীতিতে আসবে? দুটো কারণ হতে পারে। এক. ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে সাধারণ জনগণকে আবেগপ্রবণ করে তোলা। দুই. একটি দেশের জনগণকে নানা ভাগে ভাগ করে ফেলা। কারণ সবাইতো একটি ধর্মের অনুসারী নয়, যা সাম্প্রদায়িক চেতনার উদ্ভব ঘটাবে। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে সংবিধান দিয়েছিলেন, তা ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংবিধান। জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ছিল সংবিধানের মূল ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্মকে সম্মান দিয়ে প্রত্যেকের ধর্মকে স্বাধীনভাবে পালনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্র যেহেতু সবার, ধর্মও সবার সমান অধিকার নিয়ে পালনের সুযোগ রাখতেই বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সকল নাগরিকের সমান অধিকার রাষ্ট্রের প্রতি। একটি রাষ্ট্রে অনেক ধর্মের অনুসারী থাকবে। তাদের ধর্ম পালনের অধিকার যেন ক্ষুণœ না হয়, তা দেখার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। কোন রাজনৈতিক দল যদি ধর্মভিত্তিক হয়, তাহলে রাষ্ট্র সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারবে না। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় হিটলার ইহুদী নিধনে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল। জার্মানিতে ইহুদীদের আধিপত্য হিটলার মেনে নিতে পারেনি। ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ছিল ধর্মকে নিয়ে। নোয়াখালীতেও তাই। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাঙালীদের নিধনে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল। ১৯৯২ সালে ভারতের (উত্তর প্রদেশে) অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ উচ্ছেদে বিজেপি সরকার ব্যবহার করেছিল ধর্মকে। রুয়ান্ডাতে তুতসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা মানেই রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াত্ব। সাধারণ মানুষকে এক ধরনের ধোঁকা দিয়ে ধর্মের নামে নিজেদের দল ভারি করা। এটি প্রতারণা। রাজনৈতিক কর্মসূচী, সুদূরপ্রসারী নীতি, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্যতার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে আশ্রয় করে টিকে থাকতে চায়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এদেশে প্রথম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাজিত মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলামের সদস্যদের নিয়ে দল গঠন করে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু করেন। সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযুক্ত করে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিলুপ্তি ঘটান। ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি সংযোজন তুলে দিয়ে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ বাতিল করে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ করে এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে সংবিধান থেকে বাতিল করে দিয়ে ধর্মের রাজনীতি অবাধ করে দেন। এখানেই শেষ নয়, বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ এ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সে অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার অনুমতি দেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এই দলটি নানা ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। খালেদা জিয়া দলের দায়িত্ব নিয়ে পুরোপুরি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রী বানিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেন জাতীয় পতাকাকে কলঙ্কিত করে জামায়াতের গাড়িতে তুলে দিয়ে। এদেশে হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, লস্কর-ই তায়েবা, আল কায়েদা, হিজবুত তাহেরি প্রভৃতি ইসলামী উগ্রবাদী সংগঠনের অনুপ্রবেশ ঘটে বিএনপির শাসনামলে। জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো পুষ্ট হয় এ সময়। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এইচ এম এরশাদ ‘জাতীয় পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলে দলের চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৮ সালের ১১ মে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র একটি ধর্মকে স্বীকার করে নিলে অন্য ধর্মের অনুসারীরা কোথায় যাবেন? মূলত এরশাদের সময় থেকে দেশে নৈরাজ্য এবং ধর্মীয় সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজনীতি জনগণের স্বার্থে, জনগণের মঙ্গলের জন্য। রাজনীতিতে অবিভাজ্য নীতি এবং পরিকল্পনা থাকতে হয়। যে ধর্মের যে গোত্রের বা যে বর্ণেরই মানুষই হোক সকলেই রাজনৈতিক সুবিধা সমানভাবে ভোগ করবে। রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাষ্ট্রের একটি কাঠামো থাকে। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা নাগরিকের দায়িত্ব। কারণ রাষ্ট্র মায়ের মতো। রাষ্ট্র নাগরিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, নিরাপত্তা সব দিয়ে থাকে। সেজন্য রাষ্ট্রকে এবং রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনানির্ভর হতে হয়। না হলে সে রাষ্ট্র বেশিদিন স্থিতিশীল থাকে না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এর উদাহরণ। সাম্প্রদায়িক কূপম-ূকতা রাজনীতিতে কখনই সুফল বয়ে আনে না। বিএনপি, জাতীয় পার্টির রাজনীতি এর দৃষ্টান্ত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অবদান রেখে যাচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ বিশে^র কাছে একটি উদাহরণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন আর প্রযুক্তির ব্যবহার দেশটিকে এখন উন্নত দেশগুলোও মডেল হিসেবে গ্রহণ করছে। প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শন এই সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি। লেখক : চেয়ারম্যান, সমাজকর্ম বিভাগ, শেখ ফজিলাতুননেসা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
×