ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জ্ঞানের পিতা সক্রেটিসের ভাবনা ও আমাদের বর্তমান সমাজ

হীরেন পন্ডিত

প্রকাশিত: ২১:১১, ৯ মে ২০২৪

জ্ঞানের পিতা সক্রেটিসের ভাবনা ও আমাদের বর্তমান সমাজ

.

দ্য ওয়াইজ ম্যান অব দ্য ওল্ড, ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের গল্পে সক্রেটিস সম্পর্কে মোটামুটি জানতে শুরু করি। যদিও শিক্ষক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সক্রেটিসের নাম আগেই শোনা হয়েছে। সবাই তাঁকে জ্ঞানের পিতা নামেই সম্বোধন করতেন। জ্ঞানের আবার পিতা কি! ছোটবেলায় এরকম অনেক প্রশ্ন সামনে আসতো কিন্তু কাউকে কোনোদিন প্রশ্ন করে বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি। পরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেকটা পরিষ্কার হয়। সক্রেটিস ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক, পাশ্চাত্য দর্শনের প্রাচীন যুগের তিনজন সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের একজন ছিলেন অন্য দুজন ছিলেন প্লেটো তাঁর শিষ্য এবং এরিস্টটল নাতি শিষ্য মানে প্লেটোর শিষ্য।

সক্রেটিস তাঁর জীবনের এই অসামান্য কৃতিত্বের কথাগুলো নিজে কখনো লিপিবদ্ধ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। দার্শনিক প্লেটোর বর্ণনা মতে দার্শনিক সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস, যিনি পেশায় একজন ভাস্কর ছিলেন, আবার অনেকের মতে একজন স্থপতি এবং তার মায়ের নাম ছিল ফিনারিটি, যিনি পেশায় একজন ধাত্রী, সক্রেটিসের স্ত্রীর নাম জ্যানথিপ। সংসার জীবনে তার ছিল তিনজন পুত্র সন্তান। সংসারে অত্যন্ত অভাব থাকার কারণে সংসার জীবনে তিনি খুব একটা সুখী ছিলেন না। সংসারের ¦ালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য তিনি প্রায় সময় দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন।

সক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে এথেন্সে বসবাস করতেন। এমনকি তাঁর নিজের সময়েও একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, তিনি তাঁর সততা, তাঁর স্ব-নিপুণতা, তাঁর গভীর দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি এবং তার দুর্দান্ত যুক্তিমূলক দক্ষতার জন্য তার অনুসারীদের দ্বারা প্রশংসা অর্জন করেছেন সবসময়। তিনিই প্রথম গ্রীক দার্শনিক যিনি নীতিশাস্ত্রের প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ব সহকারে অন্বেষণ করেছিলেন। সক্রেটিসকে নিয়ে এথেন্সে ব্যাপকভাবে ঘৃণা সৃষ্টির একটা ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা হতো প্রথমত তিনি নিয়মিত মানুষদের কাছে নিজেকে অজ্ঞ এবং বোকা দেখিয়ে বিব্রত করার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

জ্ঞানের পিতা সক্রেটিস থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেক দার্শনিক, চিন্তাবিদ, গবেষক, শিক্ষাবিদ শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করেছেন। তবে আজও তারা শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো অভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিতর্ক শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মধ্যে তিন ধরনের মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। এক শ্রেণির দার্শনিকগণ মনে করতেন শিক্ষা অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার নয় বরং শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান অর্জন। কাজেই অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দান অসমীচীন। আর এক শ্রেণির দার্শনিকগণ বিশ্বাস করতেন যে, বিদ্যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয়-বাড়িয়ে দেয়, কাজেই অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেওয়া ন্যায়সঙ্গত। তৃতীয় মতবাদের প্রবক্তারা মনে করতেন বিদ্যার জন্য অর্থের ঠিকই প্রয়োজন আছে। তবু বিদ্যাকে অর্থের দাসে পরিণত করা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়।

সক্রেটিসের মতে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো আত্মার বিকাশ, অর্থ উপার্জন নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অর্থের বিনিময়ে বিদ্যা বিক্রয় পাপ। তিনি অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাকে ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। প্রেটাগোরাস বিশ্বাস করতেন, বিদ্যার মূল উদ্দেশ্য হলো বাস্তব জীবনে সাফল্যের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা। কাজেই তিনি শিক্ষাদানের জন্য অত্যন্ত চড়া মজুরি দাবি করতেন। প্রতি ছাত্রের শিক্ষার জন্য প্রায় দশ হাজার রৌপ্যমুদ্রা। এরিস্টপাসও শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সক্রেটিসের সঙ্গে একমত ছিলেন না। অন্যদিকে প্রেটাগোরাসের সঙ্গেও একমত ছিলেন না। তিনি বলতেন বিদ্যার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যও নয় আবার ঐশ্বর্যও নয়।

একদল মনে করেন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য শুধু পার্থিব কল্যাণই নয় বরং পরকালীন মুক্তি লাভও এর আওতাভুক্ত। তারা ধর্মকেও শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে এক করে দেখেছেন। তাঁদের মধ্যে এরিস্টটল অন্যতম। তিনি বলেন, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা। কমেনিয়াস-এর মতে, শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা। অন্যদিকে যারা শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে ধর্মকে এক করে দেখেননি অর্থাৎ যারা সাধারণভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট, জনলক, জনডিউক, পার্কার প্রমুখ দার্শনিক শিক্ষাবিদগণ।

শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভাবনা অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ। জনলক বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্তকরণ। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত নিয়ে দার্শনিক প্লেটো একটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, শরীর আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সেসব গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন যে সকল গুণাবলী নিয়ে একটি শিশু এই পৃথিবীতে আগমন করেছে। অন্যদিকে শুধু পয়সা উপার্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। তবে এটা পরোক্ষ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রত্যক্ষ বা আসল উদ্দেশ্য হবে জ্ঞানদান জ্ঞান আহরণ।

দার্শনিক সক্রেটিসের নাম সমগ্র বিশ্বে উজ্জ্বল ভাস্কর হয়ে আছে। তিনি এমন এক যুক্তিবিদ এবং নির্ভীক সত্যের প্রতীক এবং মূল্যবোধের দার্শনিক আদর্শের প্রবর্তক যা কিনা পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা দর্শনকে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু একটু ভাবলে যে বিষয়টি আমাদের সামনে পরিষ্কার তা হলো মহাজ্ঞানী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বব্যাপী যার এত সুনাম সেই সক্রেটিসের জীবন দর্শন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে আধুনিক বিশ্বে সংস্কৃতি সভ্যতার যুগে তার জীবন দর্শন এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের উল্লেখ করা যায়।

সক্রেটিস এই জগতের নিগুঢ় রহস্য নিয়ে আলোচনার চেয়ে জীবন সমাজের বাস্তব বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায় তিনি ছিলেন বেশি আগ্রহী। যেমন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? মানুষের মূল্য কোথায়? মানুষের চরিত্র কোথায়? মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব মহত্ত্ব কিসে নিহিত? জাতীয় জীবন ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানই ন্যায়নিষ্ঠ শুভ জীবন যাপনের জন্য তার দৃঢ় বিশ্বাস ন্যায় শুভ কি, তা জেনে কেউ ন্যায়বান কল্যাণ নিষ্ঠ হতে পারে না। তার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান প্রজ্ঞাই মানুষের সচারণ ভিত্তি। আর এক ধাপ এগিয়ে সক্রেটিস বলেন, আচরণের জন্য জ্ঞান বৃদ্ধি যে অপরিহার্য শুধু তাই নয়, সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো অন্যায় করতেই পারেন না। ন্যায় কল্যাণের ধারণা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কি করে অন্যায় অকল্যাণ প্রবৃত্ত হতে পারে ছিল তার চিন্তার বাইরে। নিজ আত্মার যতœ নেওয়া আত্মাকে সৎ শুভ লক্ষ্যে পরিচালিত করা মানুষের লক্ষ্য।

জ্ঞানের মধ্য দিয়েই মানুষ একমাত্র সত্য জিনিসটা চিনতে পারে। যখন তার কাছে সত্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে আর কোনো অন্যায় বা পাপ কাজ করতে পারে না। মূর্খতা বা অজ্ঞানতা থেকেই সব পাপের জন্ম। তিনি সব সময় চাইতেন মানুষের মনের অজ্ঞানতাকে দূর করে তার মধ্যে বিচার বুদ্ধি বোধকে জাগ্রত করতে। তিনি এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছেন যা দীর্ঘ ২০০০ বছর ধরে পাশ্চত্য সংস্কৃতি, দর্শন সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। সক্রেটিস ছিলেন এক মহান সাধারণ শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তিনি মানব চেতনায় আমাদের ইচ্ছাকে নিন্দা করেছেন কিন্তু সৌন্দর্য দ্বারা নিজেও আনন্দিত হয়েছেন।

তবে আমাদের সমাজে ধারণাগুলোর পরিবর্তন হয় প্রতিনিয়ত, আমরা মানবীয় গুণাবলী বিসর্জন দিচ্ছি প্রতিনিয়ত, হারিয়ে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা, লোপ পাচ্ছে আমাদের ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। মানুষের প্রতি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে, প্রেম-ভালোবাসা দয়া-মায়া, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। আমরা কিন্তু মানবীয় গুণাবলী হারিয়ে ক্রমেই মানুষ হিসেবে নয়, ক্রমেই অমানুষ হয়ে হিংস্র প্রাণীর মতো নিষ্ঠুর আচরণ করা শুরু করেছি। এমন কেন হচ্ছে? আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি আমাদের মধ্যে মানবতাবোধ যেখানে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেখানে মানবতাবোধ প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? শিক্ষিত মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলী আরও বেশি থাকার কথা, তা কিন্তু এখন আর দেখা তেমন দেখা যাচ্ছে না।

ভালো-মন্দের বিচারক্ষমতা দ্বারা যে বিবেক নির্ধারিত হয় সে ব্যাপারে সকলেই একই বিন্দুতে থাকবেন নিঃসন্দেহে তা বলা সম্ভব, ভিন্ন বিন্দুতে থাকবেন ভালো-মন্দ আলাদা করা নিয়ে অর্থাৎ কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা নির্ধারণে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে। ভিন্নতা হতে পারে ব্যক্তি, সমাজ, এলাকা, সময়, ঘটনা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। বিবেকের কাজ হলো কোনো কিছুর ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, সক্ষমতা-অক্ষমতা, নীতির কাছে সঁপে দিয়ে বর্তমানকে ভিত্তি ধরে ভবিষ্যৎ ভাবনাকে বিচার করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানবসত্তাকে সহযোগিতা করা, কিন্তু আসল সিদ্ধান্তে আসতে হবে সত্তা নিজেকেই।

আমরা প্রত্যেকেই দেশের শান্তির কথা বলি, সবার মিলনের কথা বলি, উজ্জ্বলতার কথা বলি, নীতির কথা বলি, সত্যের কথা বলি, সাফল্যের কথা বলি এমনকি এসব কথা শুনতেও পছন্দ করি, কাজের বেলায়ও এসবের তরে নিজেকে সঁপে দিতে ভালো লাগে, কিন্তু যখন দেখা যায়, অন্যের তুলনায় নিজের থলেটা তেমনভাবে পূর্ণ হচ্ছে না তখনই বিবেক হয়ে ওঠে হিংস্র আর যে শান্তি কিংবা অন্য ইতিবাচক কিছুর জন্য নিজেকে তুলে ধরা হয়েছিল সেসব কিছু একটি অসুস্থ বিবেক এসে ঢেকে ফেলে যেমন করে মেঘ এসে আকাশের নীলকে অদৃশ্য করে দেয়, যা নিতান্তই কষ্টের জন্ম দেয় সবার মনে। যা একটি অগ্রসর সমাজ বিনির্মাণে চ্যালেঞ্জ হয়েও দেখা দিতে পারে। বিষয় নিয়ে ভাবার সময় এখনই।

×