ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

কবি ও কবিতার শরীর

বিমলেন্দু রায়

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ২৩ নভেম্বর ২০২৩

কবি ও কবিতার শরীর

মানুষের মধ্যে উপলব্ধি বোধ ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়ে কর্মক্রিয়া সম্পন্ন করে ইন্দ্রিয়

মানুষের মধ্যে উপলব্ধি বোধ ও জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়ে কর্মক্রিয়া সম্পন্ন করে ইন্দ্রিয়। মানুষের মধ্যে তিন ধরনের ইন্দ্রিয় বোধ আছে। কর্মেন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়। বাক, হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয়গুলো মানুষের শারীরিক কর্মক্ষমতার প্রতীক। এর মাধ্যমে মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তু সমাজবদ্ধভাবে বসবাস, চলাফেরা ও প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে শাণিত করে। পরস্পরকে জানা, চেনার মাধ্যমে ভাবের বিনিময় আদান প্রদান করে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে প্রসারিত করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে উৎসাহিত হয়। সুস্থ মানুষ ও সুস্থ সমাজ গঠনে জ্ঞানের বিকল্প নেই।

মুর্খের কাছে জ্ঞানের কদর না থাকলেও নিয়মতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় জ্ঞানীরা অমলিন, বরেণ্য। মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত এই চারটি অন্তরিন্দ্রিয়। এই অন্তরিন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কবিরা তাদের উপলব্ধিজাত আহরিত জ্ঞানই কবিতার ফসল। উপলব্ধি সজ্ঞাত জ্ঞানই গল্প, প্রবন্ধের অনুষঙ্গ কথামালা। কবি, লেখকরা তাদের ইন্দ্রিয়ের দরজাগুলো খুলে রাখেন সর্বদা। মানুষ যেমন মাছ ধরার জন্য জাল দিয়ে ফাঁদ পাতেন নদীতে তেমনি কবিরা বা জ্ঞানীরাও তাদের হৃদয়ের দরজা খুলে রাখেন সতর্কভাবে সর্বদা চলমান দুনিয়ার কর্মকাণ্ডে। চলমান দিন-রাত্রির সব দৃশ্যপট, কথামালা তাদের হৃদয় দর্পণে ধরা পড়ে যখন তখন তারা কলম বন্দি করেন। লিখে রাখেন দিনপত্রীতে।

তখন একজন কবি হয়ে যান ধ্যান মগ্ন ঋষির মতোন। কবির এই উপলব্ধি কোনো দুঃখ বেদনা বা আনন্দের হতে পারে। তার বিচরণ ক্ষেত্র প্রকৃতি বা প্রকৃতির অন্য কোনো ক্ষেত্র হতে পারে। হতে পারে পার্থিব অপার্থিব সসীম থেকে অসীমের কোনো জগত জিজ্ঞাসা। কবিরা সাগরের নীল জলে অবগাহন করেন। যেখানকার আহরিত অনুভূতির অভিব্যক্তিই কবিতা। কবির জগৎ চেতনার জগৎ। কবিরা সময়ের ভাষ্যকার। কবি হৃদয়ের দরজা খুলে রাখেন। সেখানে খণ্ড খণ্ড ভাব অখ-রূপে ধরা পরে। কবিতা একটি মহৎ শিল্প মাধ্যম। নিজের অস্তিত্বের শনাক্তকরণে কবিতার জন্ম হয়। কবিতা বোধের বহির্প্রকাশ ক্যামেরাবন্দি দলিল। কেউ সাম্যের, কেউ বিদ্রোহের, কেউ প্রেমের, কেউ প্রকৃতির জগতে বিচরণ করেন।

সেখান থেকে আহরিত জ্ঞান কথা তুলে ধরেন শব্দে, কথায়, পাঠে। তাই কবিরা ইতিহাসের সুন্দর বার্তাবাহক। জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন গ্রাম-বাংলাকে দেখেছেন, চিনেছেন তুলে এনেছেন শব্দে, কথায় পাঠে। প্রকৃতির সঙ্গে কত নিবিড় হয়ে যান একজন কবি। তাইতো জীবনানন্দ দাশ তার ‘ঘাস’ কবিতায় লিখেছেন- ‘আমার ইচ্ছে করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে গেলাসে, পান করি।’ আধুনিক পঞ্চপ্রধান কবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হন কবি জীবানানন্দ দাশ। ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খ চিল শালিখের বেশে।’ পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তার ‘কবর’ কবিতায় লিখেছেন- ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’

কবিরা কাব্যভূমি চাষ করে বটের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। কবিরা দেশ, জাতির কল্যাণ সম্পর্কে বা সমাজের কোনো অসঙ্গতি প্রসঙ্গে পরোক্ষভাবে কবিতায় লিখে সমাজকে জাগ্রত করেন। তাইতো কবিরা কলম সৈনিক বা শব্দ সৈনিক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠক, গায়ক, আলোচক বা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে গান, কবিতা, সংবাদ সেই সময়ে সমাজভিত্তিক চেতনায় মুক্তিযোদ্ধাদের জাগরিত করেছিলেন। এই জন্য আজ তারা শব্দ সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা। তাইতো রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায় লিখেছেন- ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।’ জাতির পতাকা আজ খামছে ধরছে সেই পুরনো শকুন।’
‘হাজার সিরাজ মরে
হাজার মুজিব মরে
হাজার তাহের মরে
বেঁচে থাকে চাটুকার, পা চাটা কুকুর
বেঁচে থাকে ঘুণ পোকা, বেঁচে থাকে সাপ।’
এখানে কবিরা সমাজের অসঙ্গতির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।

যার হাত দিয়ে বাংলা কবিতা বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায়। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আকাশের অসীমতা, সাগরের গভীরতার সঙ্গে যার কাব্য প্রতিভা তুলনীয়। সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য ভাবা যায় না। বাংলা সাহিত্য মানেই রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা বা দিক নেই যা ওনার স্পর্শে আলোকিত হয় নাই। আধুনিক বাংলা কাব্য যখন প্রায় সবদিক দিয়ে রবীন্দ্রময় তখনি আলোকবর্তিকা হয়ে বাংলা কাব্যের জগতে প্রবেশ করেন জীবনানন্দ দাশ। সঙ্গে ছিল তার আরও চারজন সাথী। এরা হলেন কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), কবি বিষ্ণুদে (১৯০৯-১৯৮২), ও কবি অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১০৮৬)।

বাংলা কবিতায় এদেরকে পঞ্চপা-ব বলা হয়। তাদের বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাবে এক নবধারার সৃষ্টি হয় যা আজ পর্যন্ত কেউ এদেরকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার জগতে হাজারো কবির প্রবেশ ঘটেছে। মাইকেল মধুসুদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পর জীবনানন্দকেই প্রধানতম কবি বলা হয়ে থাকে। বাংলা কবিতায় বহুদিনের প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবনানন্দ নিয়ে এসেছিলেন আধুনিক গদ্য কবিতা। তিনি দেখিছেন আধুনিক গদ্য কবিতার পথ। কবিরা সমাজকে দেখেন, বিশ্বকে দেখেন। এই দেখার অনুভূতির বহির্প্রকাশ করেন তারা তাদের কবিতায়। তাই কবিরা চলমান দুনিয়ার প্রতিচ্ছবি, সময়ের ভাষ্যকার। কবিতা আলো আঁধারি কথামালার চিত্রপট। যেখানে পাঠককেও বোদ্ধা হতে হয় সেই বোধের বোধিসত্তা উন্মোচনে।

তখন কবি ও কবিতা হয়ে উঠে এক অখ- সত্তার আধার। পাঠকহীন কবিতা নিশ্চল, অসার। তাই কবিতায় পাঠকের চাহিদা, রুচির প্রতি সম্মান দেখানো একজন কবির কর্তব্য। একজন কবিকে জানতে হয় বিশ্বকে। জানতে হয় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে। জানতে হয়, ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম, দর্শনকে। একটি কবিতা পাঠকের বুদ্ধিকে প্রসারিত করে, প্রসারিত করে তার চিন্তার জগতকে। আমাদের দেশের স্বনামধন্য কবিদের মধ্যে কবি শামছুর রাহমান, কবি নিমলেন্দু গুণ অন্যতম। তারা এদেশের কবিতার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন।
তাই কবিতা নিয়ে, কবিতার শরীর নিয়ে এভাবে বলা যায়-
কবিতা, তুমি শব্দের শরীর নিয়ে
শব্দের সমাজে কর বাস
জাতপাতহীন
লালনের জাত
বোধিবৃক্ষ সজীব সমাজ।

তোমার পরাগায়ণ কবির বীর্যে
রোদেলা দুপুরে, রাতের আঁধারে
ঘন ঘোর বর্ষায়
নির্জনে প্রণয় কাতর
সুন্দরের ধ্যান
যোগাবিষ্ট অন্তরের অন্তরিত প্রাণ।

×