ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পৌষ-পার্বণে পিঠা

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২১:১২, ৫ জানুয়ারি ২০২৩

পৌষ-পার্বণে পিঠা

পৌষ-পার্বণে পিঠা

বাংলার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। নানা ধর্ম-বর্ণের মিশেলে সংস্কৃতিতে এসেছে ভিন্ন ধারা। সেই আদিকাল থেকেই এই ধারা একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করে আসছে। আতিথেয়তায় বাঙালির সুনাম বিশ্বজোড়া। আবার এই বাঙালি চিরকালই ভোজনরসিক হিসেবে পরিচিত। বাঙালি খেতে পছন্দ করে। খাওয়াতেও পছন্দ করে। খাওয়ার একটি দিক হলো পিঠা। পিঠা মানেই শীতকাল। পিঠার কথা উঠতেই বাংলামুলুকে পৌষ-মাঘের কথা আসে। এ মাস এলেই সবাই যেন নষ্টালজিক হয়ে ওঠে। কারণ, সেই আদিকাল থেকেই বাংলার প্রতিটি ঘরে পিঠা বানানোর কার্যক্রম চলে। অতিথিরা বেড়াতে আসে। চলে পিঠা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন।

ধনী গরিব প্রতিটি ঘরে ঘরে সাধ্যমতো পিঠা বানানোর তোড়জোড় চলে। হাজার বছর ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে এই সংস্কৃতি চলে আসছে। এটা যতটা না খাওয়ার উৎসব তার থেকে বেশি বাংলার প্রাণের উৎসব। উৎসবের মতো করেই আয়োজন করে পিঠা খাওয়ার আয়োজন চলে আসছে। সেই ছোটোবেলা থেকেই টোনাটুনির পিঠা খাওয়ার গল্প শুনেই আমরা বড় হয়েছি। অর্থাৎ পিঠা রসনা তৃপ্তি থেকে ঢুকে গেছে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিতে। 
পিঠা খাওয়ার জন্য পৌষ-মাঘ বেছে নেওয়ার কারণ হলো ঋতুর হিসেবে এসময় শীতকাল চলে। পিঠা তৈরির নানা রকমের গুড় এ সময় বাজারে আসে। মিষ্টি খেজুরের রস থেকে খেজুরের গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড় এসব এ সময়েই পাওয়া যায়। গুড়ের মিষ্টি গন্ধে চারদিকে ম-ম করে। এইসব গুড় থেকে তৈরি পিঠা খেতে অত্যন্ত মজাদার। এসব গুড় শীতকাল ছাড়া দেখা পাওয়া যায় না। তাই পিঠা তৈরির জন্য শীতকালই উপযুক্ত। তাছাড়া শীতের সকালের পিঠার স্বাদ অন্য যেকোন সময়ের চাইতে আলাদা। ঋতুর বৈচিত্র্যময়তা যে এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। তাইত বাঙালি পিঠাপ্রিয় সেই সঙ্গে অতিথি প্রিয়ও বটে।

পিঠার সঙ্গে পৌষ সংক্রান্তি শব্দটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মবলম্বিদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা পুড়িয়ে (চিতই পিঠা বানানোর মাটির পাত্র) পিঠা তৈরি শুরু করে। অনেকেই আজও এই দিনের আগে পিঠা খান না। আর তাই এই সংক্রান্তি পিঠা উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৌষ সংক্রান্তিকে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়ে থাকে। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিনে এই উৎসব হয়ে থাকে। শেষের দিন হলেও সাধারণত দুই তিন দিন ধরে হরেক রকম পিঠা বানানোর কাজ চলে প্রতিটি হিন্দু বাড়িতেই। চলে জামাইকে নিমন্ত্রণ অথবা জাামাইয়ের বাড়িতে তৈরি পিঠা পৌঁছে দেবার পালা।

একসময় গ্রাম বাংলায় বেশ ঘটা করে এইদিন পালনের রেওয়াজ ছিল। তবে কালের বিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেসব রীতিনীতি। এই বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করা হতো। তাছড়া বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই বাজি ফুটানো, ফানুস ওড়ানো এসব আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়ে আনন্দমুখর এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটত। পিঠা যে শুধু খাওয়া নয়, বরং সবাই মিলে আনন্দ করার এক অনুষঙ্গ সেটাও টের পাওয়া যায় এই উৎসব থেকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিায়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদ্যাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদ্যাপিত হয়। অবশ্যিকভাবে দেশভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য। জানা গেছে, প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এইদিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। পৌষ সংক্রান্তিতে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদ্যাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়া, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়।

পৌষ সংক্রান্তির মাধ্যমে আমরা পৌষ মাসকে বিদায় জানাই ও মাঘ মাসকে আলিঙ্গন করি। সংক্রান্তির দিনে বাংলার বধুরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন নকশা ও সুস্বাদু পিঠা  তৈরি করেন। পঞ্জিকা মতে, পৌষ সংক্রান্তি পালিত হয় পৌষ মাসের শেষ দিন। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় এইদিন। বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মীয় গুরুত্বের জন্য বিভিন্ন স্থানে এ দিবসটিতে কীর্তন, পালা গানেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে।
‘পিঠে’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পিষ্ঠক’ থেকেই এসেছে। পিঠে-পুলি খাওয়ার চল গ্রামবাংলার অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। এমনভাবে মিশেছে যেন পিঠে নিজেই এক উৎসবের নাম। পিঠা আর আমরা বাঙালিকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। বাঙালি কতটা অতিথিপরায়ণ তা এইসময় বেশ ভালোভাবেই বলা যায়। এই সময় নতুন ধান ওঠে, খেজুর গাছের হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্য নিয়মিত। এই খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্যও দেখার মতো। রস থেকে গুড় বানানোর পদ্ধতিও এক দেখার মতো বিষয়। দুই ধরনের খেজুর গুড় সংগ্রহ করার পদ্ধতি আছে । এক হলো প্রতিদিনের সন্ধ্যায় নতুন হাঁড়ি লাগিয়ে রাখা থাকে, পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বেই তা সংগ্রহ করে ফের নতুন হাঁড়ি লাগিয়ে দিয়ে যায় গাছিরা। গাছের রস একদিন জিরিয়ে নিলে, তার থেকে আরও ভাল মানের রস পাওয়া যায় মধুর মতো মোলায়েম ও পাতলা। 
এই নতুন গুড় মেশানো দুধের মধ্যে নারকেল পুরের সাদা সাদা পুলি-পিঠের সোহাগি সাঁতার চোখ আর মনকে তৃপ্ত তো করেই, তার সঙ্গে জিভের জন্য যে অসাধারণ স্বাদের জোগান দেয়, তার সঠিক বর্ণনা বোধহয় শুধু জিভের স্বাদকোরকগুলোর কাছেই লুকিয়ে থাকে । বাংলাদেশের বিশেষ কিছু পিঠের মধ্যে অন্যতম হলো, বিনি পিঠে, মালপোয়া পিঠে, সিমুই পিঠে, সূর্যমুখী পিঠে, ঝিনুক পিঠে, চিতই পিঠে, খেজুর পিঠে, বিনুনির মতন গড়া বেনি পিঠে, ঝালকুশ পিঠে, মিঠে নকশায় সাজানো নকশই পিঠে, পাঁপড়ের আকারের মলকো পিঠে, করলা পিঠে, চঙ্গা পিঠে, মুঠা পিঠে ও রস চিতই পিঠে । 
আজ বাজারে কেক, প্যাটিস পিৎসা-সহ বাজারজুড়ে ফার্স্ট ফুডের দাপট।  নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পিঠেপুলির স্বাদ ভুলতে বসেছে। বাজারে গিয়েই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তেলেভাজা চপ, বেগুনি খাওয়ার দৃশ্যই এখন পরিচিত। পিঠা বিষয়টা যেন বেশিরভাগ সময়ই অপরিচিত থাকে নতুন প্রজন্মের কাছে। আজকাল অনেক তরুণী ও বধুদের অনেকেই পিঠেপুলি ও পাটিসাপটা কিভাবে তৈরি করতে হয় তা শেখেইনি । তবে বিষয়টা হলো পিঠা আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। আমরা চাইলেও সে অংশকে আলাদা করতে পারব না।

×