
দক্ষিণ জাপানের তোকারা দ্বীপপুঞ্জে রাত আর দিন হারিয়ে গেছে এক বিস্ময়কর আতঙ্কে।
যেন মাটি শ্বাস নিচ্ছে, প্রতিবার নিশ্বাসে কাঁপছে এই ছোট ছোট দ্বীপগুলো – দুই সপ্তাহে ৯০০ বারের বেশি ভূমিকম্প।
একজন মা বলেন – “সব সময় মনে হয় নড়ছে, বাচ্চাদের কোলে নিয়েই ভাবি, এবার কোথায় যাব?”
এই ভয় নিছক এক কল্পনা নয়। ২৩ জুন এক দিনেই রেকর্ড ১৮৩ বার কম্পন! আবার ২ জুলাই বিকেলে ৫.৫ মাত্রার শক্ত কম্পনে নতুন করে সতর্কতা। রাতের অন্ধকারে জেগে থাকা মানুষদের চোখে ভাসে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
তবুও আশ্চর্য – এখনো বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। যেন প্রকৃতি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছে – “আমি এখনো জাগ্রত।”
জাপান – নামেই যেন লেখা আছে ভূমিকম্পের গল্প।
পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি। কারণ তার অবস্থান চার বিশাল টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে – প্রশান্ত প্লেট, ফিলিপাইন সাগর প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট, উত্তর আমেরিকান প্লেট।
এই সংযোগস্থলকে বলা হয় “প্রশান্ত মহাসাগরের রিং অব ফায়ার” – পৃথিবীর ৭৫% সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আর ৯০% বড় ভূমিকম্প এই বলয়ের ভেতরেই হয়।
যখন প্লেটগুলো একে অপরের দিকে এগোয় বা নিচে ঢুকে যায়, গোপনে জমে যায় বিশাল শক্তি। অবশেষে সেই শক্তি মুক্তি পায় এক মুহূর্তে – এক ধ্বংসাত্মক কম্পনের রূপে।
তোকারা দ্বীপপুঞ্জের নিচের সমুদ্রতল আরও জটিল – এক বিশৃঙ্খল, সক্রিয় টেকটোনিক প্রেক্ষাপট। মাটির নিচে যেন এক বিপুল ভাঙচুর চলে – চাপ জমে, ফেটে যায়, আবার থামে না। এভাবে হানা দেয় শত শত ছোট-বড় ভূমিকম্প।
জাপান জানে ভূমিকম্প মানে কী।
২০১১ সালের ১১ মার্চ – গ্রেট ইস্ট জাপান ভূমিকম্প, ৯.০ মাত্রা। ভয়ংকর সুনামি গিলে নিয়েছিল ১৮ হাজার মানুষের জীবন, ডুবিয়েছিল পুরো শহর, আর ফুকুশিমা পারমাণবিক দুঃস্বপ্ন।
১৯৯৫ সালের কোবে ভূমিকম্প – ৬৪০০ জনের মৃত্যু।
জাপানবাসী বোঝে, মাটির নিচে শত্রু লুকিয়ে থাকে সব সময়। তাই প্রতিরোধের শিল্প তারা রপ্ত করেছে।
ভূমিকম্প জাপানের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। স্কুলে শেখানো হয় “ডাক-কভার-হোল্ড” – কিভাবে টেবিলের নিচে ঢুকে বাঁচতে হবে। শহরের প্রতিটি ভবন নকশা হয় ভূমিকম্প-সহনশীল করে। বড় কোম্পানির অফিসে থাকে জরুরি খাবার-পানির ভাণ্ডার। নিয়মিত হয় মহড়া – কখনো খেলাচ্ছলে, কখনো রূঢ় বাস্তবতায়।
তোকারার মতো দুর্গম দ্বীপগুলোতে এখন নিরাপদ আশ্রয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব জায়গায় কি আছে সেই সুযোগ? সব পরিবার কি পারবে একসাথে সরে যেতে?
তোকারা দ্বীপপুঞ্জে আজকাল রাত মানে আতঙ্কের ঘুমহীনতা। দুপুর মানে – বাচ্চাকে জড়িয়ে রাখা আর হঠাৎ হঠাৎ মৃদু দুলুনি।
বাসিন্দারা বলছেন – “মাটি সব সময় নড়ে, আমরা ঠিক করে শ্বাসও নিতে পারি না।”
প্রকৃতি যেন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে – “আমি আছি, আমার কাছে মানুষ ক্ষুদ্র।”
কিন্তু জাপানিরা শুধু আতঙ্কে কুঁকড়ে যায় না।
তারা শিখে নিয়েছে ভয়কে মেনে চলা, প্রস্তুত থাকা – দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকা।
তাদের ইতিহাস বলে – যতবার মাটি কাঁপুক, তারা আবারও দাঁড়াবে।
তোকারা দ্বীপের এই ভূকম্পন কবে থামবে?
আবহাওয়া সংস্থা বলছে – কেউ জানে না।
বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করে দিচ্ছেন – “এখনো শেষ হয়নি।”
এখনো বেঁচে থাকার লড়াই।
এখনো মানুষের ঘুমহীন রাত।
কিন্তু এই ভয়াবহতার মাঝেও এক মানবিক দৃঢ়তা –
“আমরা প্রস্তুত থাকব, বাঁচব – কারণ আমরা জাপানি।”
রাজু