ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

আবু আফজাল সালেহ

শামসুর রাহমানের কবিতা সময়ের কড়চা

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২২ অক্টোবর ২০২১

শামসুর রাহমানের কবিতা সময়ের কড়চা

শামসুর রাহমানের কবিতার মাধ্যমে বাঙলা কবিতায় এক বাঁকবদল দেখা যায়। ভাষারীতির প্রয়োগ ও নতুন নতুন শব্দ, উপমা প্রয়োগ, চিত্রকল্পনির্মাণে নতুনত্ব এনে পরিষ্কার পার্থক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কবিতায় তিনি ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন সঙ্কট, স্বাধীনতা ইত্যাদির বৈচিত্র্যময় শব্দ, উপমা ইত্যাদি ব্যবহার করে চিত্রকল্পনির্মাণ করেছেন তিনি। কবি যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন তখন বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যে ক্রান্তিকাল চলমান। ইতিহাস-ঐতিহ্য, রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্কট, ভাষাবিকৃতি ও বর্ণমালার উপর আঘাত ইত্যাদি সঙ্কটে জর্জরিত এ অঞ্চল। এসব সঙ্কটে সামনে থেকেছেন তিনি। কবিতা ও বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন অকুতোভয় নিয়েই। কবি শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬) ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি/গোলাপ নেব ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি/লাশ নেব না (ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)’ ইত্যাদির মতো প্রতিবাদি এমন অনেক কবিতা লিখেছেন। তিনি নিরীহ প্রজাদের প্রতি শাসকদের চরম অনীহা দেখতে পান। সরকারের বিলাসিতা কিন্তু থেমে থাকেনি। অথচ সাধারণ জনগণই সব ক্ষমতার শক্তি। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকার ও নেতাদের প্রতি কটাক্ষ করে লেখেন, ‘ধন্য রাজ্য ধন্য,/দেশজোড়া তার সৈন্য।/... দু’মুঠো নেই অন্ন,/ধন্য রাজ্য ধন্য(রাজকাহিনী)’। শামসুর রাহমানের সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় একটি কবিতা ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?।’ কিছু অংশ তুলে ধরা যাক- ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?/তেমন যোগ্য সমাধি কই?/...তাই তো রাখি না এ লাশ আজ/মাটিতে পাহাড়ে কিংবা সাগরে,/হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই’। তাঁর কবিতার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় এক বাঁকবদল দেখা যায়। ভাষারীতির প্রয়োগ ও নতুন নতুন শব্দ, উপমা প্রয়োগ, চিত্রকল্পনির্মাণে নতুনত্ব এনে পরিষ্কার পার্থক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কবিতায় তিনি ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন সঙ্কট, স্বাধীনতা ইত্যাদির বৈচিত্র্যময় শব্দ, উপমা ইত্যাদি ব্যবহার করে চিত্রকল্পনির্মাণ করেছেন তিনি। ‘আমার কবিতা গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ায় নূহের/দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে/চে গুয়েভারার বয়ে যাওয়া/রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে(শুচি হয়/ মঞ্চের মাঝখানে)’ অথবা ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,/নতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা) ইত্যাদির মতো কবিতার কবি হচ্ছেন শামসুর রাহমান। তাকে নাগরিক কবি বলা হয়। ঢাকার স্মৃতি, পুরাতর ঢাকার দুর্ভোগ ইত্যাদির বর্ণনা কবিতার ভাষায় পাওয়া যায়। নতুন স্বপ্ন ও জাগরণের গল্প শুনি শামসুর রাহমানের কবিতায়। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক সমস্ত গণআন্দোলন নিয়ে কলম ধরেছেন প্রকাশ্যে, কবিতার পরতে পরতে বিরুদ্ধচারীদের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো শব্দবর্ষণ। রক্তজবার মতো টুকটুকে লাল ও উজ্জ্বল উচ্চারণ তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় বাঙালী ও বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় ছিল তাঁর সময়কার। সে সময়ের প্রবল প্রতিকূলতা ও বিষয় কবিতার উপাদান হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তান আমলে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদি তাঁর কবিতার শব্দে যোগ হয়েছে। আবার প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সঙ্কট ও গ্লানির চিত্র। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ছিল সবাক, সংগ্রাম-মুখর। ‘বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,/স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে/আমি বড় ঈর্ষান্বিত আজ।/... যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,/কখনও অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনও বা/সেসব কবিতাবলি, যেন রাজহাঁস/...অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ/ এ বন্দী বন্দী শিবিরে/মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ/মনের মতন শব্দ কোন।/...স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বার বার/তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে-কানাচে (বন্দী শিবির থেকে)’। ১৯৭১ সালের ২১ জুলাই কলকাতার নন্দিত ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। ‘মজলুম আদিব’ অর্থ নির্যাযিত কবি। বাঙালীর সঙ্গে নিজেও স্বাধীনতা প্রত্যাশী হয়ে এ কবিতায় আরও লেখেন : ‘স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার/তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে/প্রতিটি রাস্তায়/অলিতে-গলিতে,/রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে/স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই/বিশাল অক্ষরে’। অক্ষরে অক্ষরে মিশে আছে আবেগ। সমস্ত বাঙালীর আবেগ যেন তাঁর আবেগে রূপান্তরিত করলেন। স্বাধীনতার রূপ দেখলেন এভাবে : ‘স্বাধীনতা তুমি/বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা (স্বাধীনতা তুমি, বন্দী শিবির থেকে)’। ‘বাঙালীর আবেগ যে কত উচ্চ’ ছিল তার বর্ণনা পাই এ কাব্যের অনেক কবিতায়। ‘স্বাধীনতা যে কত আকাক্সিক্ষত’ তা পাওয়া যায় এ গ্রন্থের ‘পথের কুকুর’ কবিতায়, ‘আমরা ক’জন শ্বাসজীবী-/ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের/শাণিত চিৎকার/কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই/পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ/একটি জিপের দিকে, জিপে/সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি/অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর’। অন্যায় ক্ষমতার প্রতি শামসুর রাহমানের প্রবল ক্ষোভ ছিল। অসংখ্য এমন প্রতিবাদী কবিতা রয়েছে তাঁর। ‘স্যামসন’ কবিতার অংশবিশেষ : ‘ক্ষমতামাতাল জঙ্গী হে প্রভুরা ভেবেছো তোমরা,/তোমাদের হোমরা চোমরা/সভাসদ, চাটুকার সবাই অক্ষত থেকে যাবে চিরদিন?/মৃত এক ঘাফহার চোয়ালে, মনে নেই ফিলিস্তিন, /দিয়েছি গুঁড়িয়ে কতো বর্বরের খুলি’। সময়কে এড়িয়ে যাননি কবি শামসুর রাহমান। বরং শক্ত করে ধরেছেন, অক্টোপাসের মতো ধরেছেন। শব্দের গাঁথুনিতে অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। আমাদের অস্তিত্ব ও অহঙ্কার হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতাÑস্বাধীনতা যুদ্ধ। আমাদের চেতনার ভিত্তি হচ্ছে ভাষা-আন্দোলন। দুটি বিষয়েই কলম ধরেছেন। বাঙালীর পক্ষে, শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। এসব চেতনা কবিতায় প্রকাশে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। বিভিন্ন আন্দোলন/সংগঠনে জড়িত হয়েছেন। এভাবেই তিনি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসাবে বাঙালীর হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছেন। আরও দুটি উদাহরণ দেয়া যাক- (১) ‘বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি;/দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পার ?/বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়/যদি মিশে যেতে পার, তবে/হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা!/...কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্য/এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং/বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকব কতকাল ?/বল কতকাল? (একটি কবিতার জন্য)’ (২) ‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট/ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,/ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকা- চোয়ালে।/...করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই/আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোরে আকাশ হয়ে যায়।/একটি বধূ...আরেক পিতার বুক-শূন্য-করা গুলিবিদ্ধ সন্তানের লাশ/নেমে যায় নীরন্ধ্র কবরে (বারবার ফিরে আসে)’। শামসুর রাহমানের কবিতার প্রধান বিষয় ছিল তাঁর সময়কার। সে সময়ের প্রবল প্রতিকূলতা ও বিষয় কবিতার উপাদান হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তান আমলে বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদি তাঁর কবিতার শব্দে যোগ হয়েছে। আবার প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সঙ্কট ও গ্লানির চিত্র। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ছিল সবাক, সংগ্রাম-মুখর। প্রথমদিকে না হলেও পরের দিকের কবিতায় রাজনৈতিক সচেতনতা হয়ে উঠেছেন। নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, অথবা ‘দুখিনী মায়ের অশ্রুজলে ফোটে ফুল’, ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’, ‘উদ্ভব উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?’ ইত্যাদি কবিতাংশ প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে-বাঙলা এবং বাঙালীর আবেগ ও অস্তিত্বে মিশে গেছে।
×