
কবিতা সত্য ও সুন্দরের কথা বলে। কবিতা সুচিত্রক, তিলোত্তমা। হৃদয়ের ছোট্ট মন্দিরে যে তোলে মনোগ্রাহী ঝঙ্কার। আবেগ ও বুদ্ধিমত্তার পরিমিত মিশ্রণ ঘটিয়ে যে একটু একটু করে খুলে দেয় বোধের সকল দরজা। কবি ও সাহিত্যিক শেলী সেনগুপ্তা সম্পাদিত ‘একান্নবর্তী’ পাঠ করতে গিয়ে কবিতার শক্তি যেন নতুন করে আবার টের পেলাম। নান্দনিক প্রচ্ছদের কবিতাপত্রটি হাতে নিতেই মন ভালো হয়ে গেল এবং প্রথমেই চোখ আটকে গেল সম্পাদকীয়র শেষ লাইনটিতে ‘একান্নবর্তী হয়ে উঠুক সব কবিদের একাকিত্বের রাফ খাতা।’ ছোট্ট অথচ কী গভীর একটি চাওয়া। সূচিপত্র দেখে আক্ষরিক অর্থেই চমকে গেলাম, দশকওয়ারী ষাট থেকে দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত তেতাল্লিশ জন কবির গুচ্ছ কবিতা এবং প্রকাশিত কবিতাগুলো নিয়ে সরকার আব্দুল মান্নানের নির্মোহ এবং প্রাঞ্জল আলোচনা। তবে ষাট দশকের কবি হিসাবে কেন কেবল রুবী রহমানকে বেছে নেয়া হয়েছে এই জিজ্ঞাসা মনে উঁকি দিয়েছে বৈকি। সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে এ সংখ্যায় লিখেছেন আলমগীর রেজা চৌধুরী, আসাদ মান্নান ‘কামাল চৌধুরী, জরিনা আখতার ফারুক মাহমাধ বিমল গুহ, ময়ুখ চৌধুরী, মাহমুদ কামাল এবং হাসান হাফিজ। এরা প্রত্যেকেই স্বনামে খ্যাত এবং কবি হিসেবে বহুল পঠিত। পড়তে পড়তে কামাল চৌধুরীর একটা লাইনে থমকে যাই ‘তোমার ডাকে মাঠ হয়ে যায় দেশ’ বঙ্গবন্ধুর উজ্জীবনী শক্তির কী গভীর চিত্রায়ণ! কবিতার শক্তি নিয়ে ফারুক মাহমুদ লিখেছেন ‘কবিতার ক্লান্তি নেই। যখন বিপন্নকাল দাঁড়ানো সে জানে’। বোধের দরজায় টোকা দিয়েছে ময়ুখ চৌধুরীর ‘সিঁড়ি মানে শুধু উত্থান নয়। একই সঙ্গে নেমে আসা দোআঁশ মাটির কাছাকাছি।’ এবং মাহমুদ কামালের ‘গোপনে সারিয়ে ফেলি ক্ষত/আমি তাই প্রকাশে অক্ষত!’
আশির দশকের কবিদের মধ্যে লিখেছেন কামরুল হাসান, খালেদ হামিদী, গোলাম কিবরিয়া পিনু, বদরুল হায়দার, মাহফুজ আল-হোসেন,রহিমা আখতার কল্পনা এবং সুহিতা সুলতানা। এরা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। গোলাম কিবরিয়া পিনুর একটি পঙ্ক্তি আমাকে বেশ ভাবিয়েছে ‘জলমগ্ন হও,/জলে ডুবে না ভাসলে বৃক্ষ পচে যায়!’
নব্বই এর নির্বাচিত কবিদের মধ্যে এ সংখ্যায় রয়েছেন ওবায়েদ আকাশ, কামরুজ্জামান কামু, জুনান নাশিত, ভাগ্যধন বড়ুয়া, মুজিব ইরম, শান্তা মারিয়া, শাহনাজ মুন্নী, শাহিন রিজভি এবং হেনরি স্বপন। এরা প্রত্যেকেই কবিতার মাঠে সক্রিয় এবং পাঠকনন্দিত। মাকে নিয়ে লেখা ওবায়েদ আকাশের প্রতিটি কবিতাই মর্মস্পর্শী। মুজিব ইরম নিশ্চিতভাবে স্বতন্ত্র, ভালো লেগেছে শাহনাজ মুন্নীর ‘ধর্ম’ শিরোনামের কবিতাটি আর শান্তা মারিয়ার ‘ওম মণি পদ্মে হুম’ ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ প্রিয় একটি কবিতা।
শূন্য দশকের কবিদের মধ্যে অতনু তিয়াস, অথির চক্রবর্তী, আদিত্য নজরুল, আফরোজা সোমা, চন্দন চৌধুরী, জুননু রাইন, পিয়াস মজিদ, ফারুক আহমেদ, শেলী সেনগুপ্তা, সেজুতি বড়ুয়া এই সংখ্যার নির্বাচিত কবি। এই দশকটির প্রতি আমার একটা প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতিত্ব আছে এবং উল্লিখিত কবিদের প্রত্যেকেই আমার পরিচিত এবং প্রিয়। পিয়াস মজিদ, চন্দন চৌধুরী, শেলী সেনগুপ্তা, অতনু তিয়াসের কবিতা মুগ্ধতা জাগানিয়া। জুননু রাইন এর এয়া সিরিজের প্রতিটি কবিতাই অনবদ্য। ‘একটা সুবেহ সাদিকে সেজদারত পৃথিবীর মুখ ভেসে উঠছে’- কী অসম্ভব শক্তিশালী চিত্রকল্প। আমাকে আপ্লুত করেছে আদিত্য নজরুলের ‘উদ্বাস্তু’ কবিতাটি। চারটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না-
‘এই হাত দুটি যুক্তরাষ্ট্র
ফিউশন রেজারটি শক্তিশালী ইজরায়েল
তবে কি অজস্র মানুষের ভিড়ে
আমি একজন হত্যাকারী?’
প্রথম দশক (মূলত দ্বিতীয় দশক হবে) তালিকাভূক্ত কবিদের মধ্যে রয়েছে অরবিন্দ চক্রবর্তী, কৌস্তব শ্রী, গিরিশ গৈরিক, তামীম চৌধুরী, মাহমুদ নোমান, শ্বেতা শতাব্দী এষ, স্নিগ্ধা বাউল। উল্লেখিত কবিদের প্রায় প্রত্যেকেই নানা রকম নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজস্ব স্বর নির্মাণে লিপ্ত রয়েছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই তা করতে পেরেছেন, বাকিরা চেষ্টারত। এই দশকের কবিরা প্রথাগততার বিরুদ্ধে মেলে দিচ্ছেন খেয়ালি ডানা। অরবিন্দ যেমন বলে দেন ‘সত্যি বলতে কি, সত্য বলে কিছু নেই। যা আছে, সব অশ্বডিম্ব আর মাসেল আর পেরেক আর পেঁপেফুল আর খনিজ আর গার্বেজ’। যেভাবে বলতে পারেন স্নিগ্ধা বাউল- ‘আলো আসছে আলো-/জন্মের নতুন সূত্র।/সীমাহীন ইতিহাসের বিরুদ্ধাচরণ /আজ/পূর্ণিমার রাতজুড়ে’।
শিল্প মানেই সুন্দরের অনুধ্যান আর কবিতা হলো শিল্পের আদি ও অকৃত্রিম স্রোত। কবিতার মাদুর বিছিয়ে শেলী সেনগুপ্তা এই সুন্দরের উপাসনাতেই মত্ত। একান্নবর্তীর প্রথম সংখ্যাটি আমাদের এই বার্তাই দিচ্ছে নিশ্চিতভাবেই একান্নবর্তী হতে যাচ্ছে কবিতাকর্মী ও কবিতাপ্রেমীদের জন্য অনিবার্য এক মায়াবী ভেষজ।