প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র। চলাফেরা, কথাবার্তা, রুচিবোধ, বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি একেক মানুষের একেক রকম হয়। অনেক বিষয়ে মিলও দেখা যায়। সেখানেই বন্ধুত্বের ভিত্তি গড়ে ওঠে। মার্কস-এঙ্গেলসের মতো বন্ধুত্বে একাকার হয়ে যান না, কিন্তু চিন্তাধারা ও কাজের সাজুয্যের মধ্যে গড়ে ওঠে ঐক্য। চিন্তা, রুচি ও কর্মধারার নৈকট্য অনেক মানুষের মধ্যে সখ্যতা সৃষ্টির একটা সমতল ক্ষেত্র তৈরি করে। বর্ষায় চৈত্রে মাঠের পরিবেশ সমস্যা জর্জরিত হলেও একসঙ্গে খেলা বা বিচরণের মনোভাব প্রতিকূল পথে খ-িত হয় না। জীবনযাপনের দীর্ঘ পথ চলায় ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক সম্পর্ক সূত্রের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন বা অন্য কোন কারণে হয়ত বন্ধুত্বের মধ্যে সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় সময় বিশেষে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বা সাময়িক দূরত্ব তৈরি হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত আন্তরিকতায় বৈরিতা স্থান পায় না।
বলতে চেষ্টা করছি শুভ রহমান ও নিয়ামত হোসেনের বন্ধুত্বের জের ধরে কিছু কথা। দু’জনেরই যাপিতজীবন ও বিচরণের ক্ষেত্র প্রায় একই। দু’জনই কবি। লিখেছেন গল্প, ছড়া, নিবন্ধ। যৌবনে চষে বেড়িয়েছেন প্রতিকূল পরিবেশে এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। থেকেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায়। পথভ্রষ্ট হননি বা আত্মসমর্পণ করেননি বলদর্পী ক্ষমতাসীন চক্রের রক্তচক্ষু বা প্রলোভনের কাছে। ছিলেন এ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা কর্মীদের অন্যতম। দু’জনই জীবিকা নির্বাহ করেছেন সাংবাদিকতায়। শুধু তাই নয়, জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই ওদের জীবন প্রায় সমান্তরাল। দু’জনের বয়সও প্রায় সমান। শুভ রহমানের জন্ম ১ জুন, ১৯৪০। আর নিয়ামত হোসেনের জন্ম তারিখ ১৫ জানুয়ারি, ১৯৪১। দু’জন মারাও গেলেন মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে। শুভ রহমানের মৃত্যু ১৩ মে, ২০১৮। আর নিয়ামত হোসেন চিরবিদায় নিলেন ১ জুলাই, ২০১৮।
দেশ বিভাগের জের ধরে দু’জনেরই ঢাকায় আগমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। অবশ্য শুভ রহমান এসেছেন মা-বাবা অর্থাৎ পরিবারের সঙ্গে। আর নিয়ামত হোসেন একা। একেবারে নিঃসঙ্গ উদ্বাস্তু হয়ে। শেকড় ছেঁড়া, সহায়-সম্বলহীন। স্বাভাবিক কারণেই এখানে স্থিতি খুঁজে পাওয়ার জন্য তাকে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করে, অনেক কষ্ট স্বীকার ও জীবনযুদ্ধ চালিয়ে টিকে থাকতে হয়েছে।
ষাটের দশকের প্রায় শুরুতে মূলত সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমেই সমমনা অন্য অনেকের সঙ্গে শুভ রহমান ও নিয়ামত হোসেনের সখ্যতা ও পথ চলা। তখন ওরা নিয়মিত লিখতেন কবিতা-ছড়া। ষাটের দশকটা ছিল সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলন সংগ্রামের ক্রম-প্রসারমান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার উত্তাল তরঙ্গমালা সৃষ্টির সাংঘর্ষিক এক দশক। সে সময়টা ছিল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন পাশাপাশি চলার এক যুগসন্ধিক্ষণ। তখনই দর্বার গতি পায় প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ভাবনা ও জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের ইতিবাচক অভিযাত্রা। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক আদর্শের বিরুদ্ধে জনরোষ পায় একটা সমন্বিত রূপ। বিস্তৃত পরিসরে গড়ে ওঠে বাঙালীর শেকড়মনস্ক ও দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি এবং মানবিক আদর্শের অনুগামী রাজনীতি। ওরা দু’জনই ছিলেন মার্কসবাদী দর্শনের অনুগামী।
ষাটের দশকে ইতিহাসের পটপরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুতির সন্ধিক্ষণে বাঙালী সংস্কৃতিকে ধর্মের আবরণে কৃত্তিমভাবে পাকিস্তানীকরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে থাকে প্রগতিশীল ধারার কালচারাল এ্যাক্টিভিস্টরা। গড়ে ওঠে ‘সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠী’, ‘ক্রান্তি’ উন্মেষ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সামরিক স্বৈরাচারের ছত্রছায়ায় আইয়ুব-মোনেম শাসকচক্র বাঙালী সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত ও দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে স্বৈরাচারী শাসকচক্রের রক্তচক্ষুকে প্রতিবাদের পথে নামে বৃহত্তর বাঙালী শিক্ষিত সমাজ। অগ্রবর্তী দায়িত্ব গ্রহণের বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে গড়ে ওঠে এ দেশের নেতৃস্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’। ১৯৬১ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় সূচিত হয় প্রগতিশীল ধারায় বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের শুভ সূচনা। এই ধারার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয় সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সৃজনী প্রকাশ করে একটি দৃষ্টিনন্দন রবীন্দ্র স্মারক সঙ্কলন। ‘সৃজনী’ ও ‘খেলাঘর’-এর মাধ্যমেই নিয়ামত হোসেন ও শুভ রহমানের সাংগঠনিকভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে দুরন্ত প্রকাশ। বিভিন্ন উপলক্ষ সামনে রেখে ‘সৃজনী’ প্রকাশ করতে থাকে সাহিত্য সঙ্কলন, মঞ্চায়ন করে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘সৃজনী’ তার সাংগঠনিক তৎপরতায় সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছে এ দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের।
নিয়ামত হোসেন ও শুভ রহমান দু’জনেই ছিলেন ‘সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠী’র সভাপতি। তারা ‘খেলাঘর’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই শিশু-কিশোর সংগঠনের প্রারম্ভিক লগ্ন থেকেই। এই সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র লিখেছিলেন শুভ রহমান আর সাধারণ সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন নিয়ামত হোসেন। এই যুগলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারণা ছিল হাতে হাত ধরে। অবশ্যই তারা পেয়েছিলেন আরও অনেক সহযাত্রী আন্তরিক সহযোগিতা ও সখ্য। ফলে সেই সময়ের বিরূপ বা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সকল বাধাবিঘœ অতিক্রম করে চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন নিজেদের গুরুদায়িত্ব। এখানে সীমাবদ্ধ পরিসরে আলোচ্য আমাদের দুই প্রয়াত সহযোদ্ধা নিয়ামত হোসেন ও শুভ রহমান। তাই অন্যদের নাম ও প্রসঙ্গ আলোচনায় বিরত রইলাম।
নিয়ামত হোসেন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন প্রথমে একটি মার্কিন প্রকাশনা সংস্থা ফ্র্যাংকলিন বুক প্রোগ্রামস-এ। পরে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাসের সংবাদ প্রচার সংস্থা (এপিএন)-এর তথ্য বিভাগে যোগদান করেন। দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর (১৯৬৪-১৯৯১) সেখানেই কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি অনেকটা শুভ রহমানের সহযোগিতায় ১৯৯৪ সালে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। আমৃত্যু তিনি সেখানেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আর শুভ রহমান দৈনিক সংবাদে বার্তা বিভাগে সাংবাদিকতা শুরু করে ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, জনকণ্ঠ হয়ে কালের কণ্ঠে কর্মজীবন সমাপ্ত করেন। জটিল হৃদরোগ ও দৃষ্টি স্বল্পতার জন্য তার লেখা ও পড়াও বন্ধ হয়ে যায়, সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তার চলাচল। ভারতে একাধিকবার ব্যয়বহুল ও জটিল শৈল্য চিকিৎসা চালাতে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত তার একমাত্র বাসস্থানটিও (এ্যাপার্টমেন্ট) বিক্রি করে দিতে হয়। যদিও সহকর্মী শুভানুধ্যায়ীদের প্রচেষ্টায় প্রাপ্ত সরকারী অনুদান তার জরুরী চিকিৎসায় সহায়ক হয়েছিল। অপরদিকে নিয়ামত হোসেনও শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে বিপর্যস্ত ছিলেন এবং নিঃসঙ্গ পরিচর্যাহীন কষ্টকর জীবনে চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছিলেন।
পারিবারিক জীবনে দুই বন্ধুর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মিল খুঁজে পেলেও কিছু বৈসাদৃশ্যও ছিল। শুভ রহমান স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা কর্মজীবনে ছিলেন আদর্শ শিক্ষিকা। ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংস্কৃতিমনা। খুবই বন্ধুবৎসলা। শুভ রহমানের বিচরণ বলয়ে আন্তরিক সম্পর্কে প্রীতিভাজন সুগৃহিণী। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে নিজে অসুস্থ থেকেও প্রায় সবার সঙ্গেই যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রেখে চলেন। হৃদরোগে অসুস্থ স্বামীর সর্বক্ষণিক পরিচর্যা ও সম্ভাব্য সকল প্রকার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় করণীয় দায়িত্ব সম্পাদন করে গেছেন অভাবিত নিষ্ঠার সঙ্গে। অপরদিকে নিয়ামত হোসেনের স্ত্রী সুলেখিকা নিলুফার হোসেন দীর্ঘদিন ছিলেন শয্যাশায়ী। কর্মজীবনে ব্যস্ত থেকেও অবসর যাপনের বেশিভাগ সময়ই নিয়ামত হোসেন ব্যস্ত থাকতেন স্ত্রীর কষ্টকর ব্যাধির নিরাময় বা উপশম-পরিচর্যায় এবং দৈনন্দিন সাংসারিক কাজে। পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও ভালবাসার আচ্ছাদনে তারা ছিলেন অনুকরণীয় জীবন সাথী।
শুভ রহমান ও নিয়ামত হোসেনের যাপিত জীবনে ছিল একটা গম্ভীর ক্ষত। শুভর প্রথম সন্তান আনন্দ রহমানÑ আমাদের সবার স্নেহের পাত্রÑ বৃত্তি পেয়ে লেখাপড়া করেছে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। লেখাপড়া শেষ করে প্রকৌশলী হয়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে দেশে ফেরার অনতিপূর্বে মস্কোয় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার অকাল মৃত্যু ঘটে। এই মর্মান্তিক মৃত্যু শুভ রহমান-ফজিলাতুন্নেছার স্বপ্নসাধ চূর্ণ করে দেয়। সন্তান হারানোর এই গভীর শোককে তারা কোনভাবেই সামলে উঠতে পারেননি। এই আকস্মিক মৃত্যু আমাদেরও করেছে শোকাহত। আনন্দ ছিল উদীয়মান কবি-সাংস্কৃতিক কর্মী। বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে নিজেদের বাড়িতেই গড়ে তুলেছিল ‘অরণী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী।’
নিয়ামত হোসেনেরও একমাত্র পুত্র লেখাপড়া করেছে বিদেশে। শিক্ষা শেষে ফিরেছে দেশে। প্রেম করে বিয়ে করেছে (যা পরবর্তী সময়ে টেকেনি)। কিন্তু পিতা-মাতার সান্নিধ্যে সংসারের দায়িত্ব নেয়নি। থেকেছে দূরত্ব বাজায় রেখে। জীবনযাপন করেছে নিজের মতো করে। চলে গিয়েছে বিদেশে। বেড়েছে পিতা-মাতার সঙ্গে আরও বেশি দূরত্ব। আর নিয়ামত-নিলুফার হোসেনের সাংসারিক জীবন কেটেছে অনেকটা নিঃসন্তান দম্পতির মতো।
স্ত্রী নিলুফার হোসেনের মৃত্যুর পর নিয়ামত হোসেন হয়ে পড়েন একেবারেই নিঃসঙ্গ। একা ছিলেন বলেই হয়ত আর্থিক সঙ্কট তীব্র হয়ে দেখা দেয়নি। থাকতেন স্ত্রীর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ফ্ল্যাটে। কিন্তু অসুস্থ শরীরের নিয়মিত চিকিৎসা, ওষুধপথ্য সেবন এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যার পরিচর্যা থেকে তিনি ছিলেন বঞ্চিত। নিয়ামত হোসেনের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। প্রৌঢ়ত্বের পর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য ও বড় সময় তিনি সৃষ্টিশীল কাজে মনোনিবেশ করতে পারেননি। এ সময়ে যা কিছু লিখেছেন সাংবাদিক জীবনে জীবিকার প্রয়োজনে। সাহিত্যচর্চা নিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষিত না হওয়ার বিষয়ে শুভ রহমানের ক্ষেত্রেও একই রকম স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয়। ফলে তাদের সৃষ্টিকর্মের বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মের কাছে জানার পরিধি অনেক কম এবং আলোচনাও তেমনভাবে হয়নি।
দুই.
কাব্য চর্চা দিয়েই শুভ রহমান ও নিয়ামত হোসেনের এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অভিযাত্রায় অংশগ্রহণের শুরু। ‘খেলাঘর’-এর সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকালে তারা দু’জনেই শিশু-কিশোরদের জন্য নিয়মিত লিখে গেছেন ছড়া। আর ‘সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠী’তে থেকে লিখেছেন মূলত কবিতা। দু’জনের চিন্তাধারার মধ্যে ছিল ঐক্য। প্রকাশ ধারায় নিজস্ব ভঙ্গি। প্রগতিশীল বাঙালী জাতীয়তাবাদের মানবিক উচ্চারণ ও আবেগ প্রকাশে উভয়ে ছিলেন কাছাকাছি। নিয়ামত হোসেন লিখেছেন :
‘আমাকে কুচি কুচি করে কাটলেও
রক্তমাংসে সবটুকুই
বাঙলা
হৃদয়ের দুঃখ শোক প্রেম, শান্তি সবটুকুই
বাঙালী’
Ñ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’
আর শুভ রহমান প্রকাশ করেছেন এভাবে :
‘আমাকে প্রতিদিন বাঙালী করো বাঙলার মাটি দিয়ে
পূত করো পবিত্র করো হে আমাকে প্রতিদিন বাঙালীই রাখো বাঙলার হাওয়া দিয়ে
সুস্থ করো পুষ্ট করো হে?Ñ ‘বাঙালী করো’
নিয়ামত হোসেন মূলত শিশু সাহিত্যেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। ছড়া-পদ্য ও শিশুতোষ গল্পের ভা-ার তার কম নয়। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি অবহেলিত মানুষ ও সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন অসীম মমতা বা দরদ দিয়ে। শিশু কাজের মেয়ে ‘মরজিনার কথা’ আমরা মনে করতে পারি।
‘খুব সকালে বাসন-কোসন মেজে
রান্নাঘর আর বারান্দাটা ঝাড়ি
তারপরে সেই নিয়ম মতো রোজ
আগুন ধরাই চুলোর পিঠে বসে।...
লুকিয়ে শুনি রানু বুজির পড়া...
ইচ্ছে জাগে একটুখানি পড়ি।
কিন্তু আমায় অমন মজার বই
কে দেবেÑ আর কে দেবে রোজ ছুটি?’...
অন্তমিল নেই, কিন্তু সঠিক মাত্রা ও সুন্দর ছন্দের আলিঙ্গনে বেঁধেছেন কাজের মেয়ে মরজিনার মন ছুঁয়ে যাওয়া কথাগুলো।
এ দেশের প্যারোডিকারদের মধ্যে নিয়ামত হোসেন নিশ্চয়ই অগ্রগণ্য। ‘নিয়ামত হোসেনের প্যারোডি’ বইটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। বিশেষ করে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র যখন নিয়ামত হোসেনের প্যারোডি নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে, তখন পাঠক সমাজে তিনি নিজের পারঙ্গমতার অবস্থানটি পাকাপোক্ত করে ফেলেন। জনকণ্ঠেও তার কিছু প্যারোডি প্রকাশিত হয়েছিল। প্যারোডি মূলত হাস্যরসপ্রধান। বিশিষ্ট কবিদের বিখ্যাত বা বহুল পঠিত কবিতার ছন্দমাত্রা অনুসরণ বা ঠিক রেখে বিষয়বস্তু ও কথাগুলো পরিবর্তন করে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা বা সময়োপযোগী বিষয়ে কথা প্রতিস্থাপন করে ব্যঙ্গাত্মক বা হাস্যরসাত্মক কাব্য রচনা করে ‘প্যারোডি’ রচনা করা হয়।
প্যারোডি সঙ্কলন ছাড়াও নিয়ামত হোসেনের অন্য বইগুলো হচ্ছে : মজার ছড়া মজার পড়া, জলছবি, অজানা কোন দেশে, প্রতœতত্ত্ব ও ফাংশন, মামা কাহিনী, ফেলু মামার হাসির গল্প ইত্যাদি।
শুভ রহমান কবিতার অঙ্গনে এসেছিলেন ভাবনায় সুভাষ সুকান্তের হাত ধরে। ষাট ও সত্তরের দশকে তার রচনায় আমরা সেই ছায়াই দেখতে পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে পুত্র আনন্দ-এর মস্কোতে দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর পরে কবিতায় তার পদচারণা অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ষাটের দশক থেকে কাব্যাঙ্গনের তার বলিষ্ঠ উচ্চারণ তৎকালীন সময়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ অনেক কবিকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। তার কবিতায় ছিল সময়ের আবেগমথিত উত্তাপ ও স্পন্দন। তার প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন জীবনব্যাপী’র কবিতাগুলো পাঠ করলে তার সমাজমনস্কতা ও সময়ের দ্রোহী কবির বিশিষ্ট রূপকে অনুভব করা যায়। আটষট্টি-ঊনসত্তরে স্বৈরাচারী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যখন ময়দান ও জনপথ কাঁপাচ্ছে ছাত্র-জনতা, তখন শুভ রহমানের কলমে রচিত হলোÑ
‘জীবনকে ভালোবাসি বলেই লড়ছি বাঁচার জন্যে
নিষ্ফল মৃত্যু আজ কারোই কাম্য নয়।
লক্ষ স্বপ্ন-সাধ বুকের আড়াল থেকে
শুকনো ফুলের মতো করুণ গন্ধ বিলোয়।
কবিতা ছাড়াও শুভ রহমান লিখেছেন গল্প, নিবন্ধ-কলাম। ‘চালচিত্র’ শিরোনামে তিনি ‘জনকণ্ঠ’, ‘কালের কণ্ঠ পত্রিকায় চাকরিকালে নিয়মিত কলাম লিখতেন। এ ছাড়া তিনি জীবিকা সূত্রে সাংবাদিকদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। তিনি ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দায়িত্ব নিয়ে অনেকটা সময় ছিলেন আগরতলায়। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার কাজে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটির পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান আমলে তার আদর্শিক রাজনীতির ধারক গোপন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হাতিয়ার’-এর সম্পাদনা ও নিয়মিত প্রকাশের কাজে যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে : রোদ্দুরে লাল প্রজাপতি, শিশিরের মুক্তো, সরস বিজ্ঞান, সবুজ গ্রহের গল্প, নানান কথা, কালের যাত্রার ধ্বনি, হাঙ্গরের সঙ্গে যুদ্ধ ইত্যাদি।
শুভ রহমান ও নিয়ামত হোসেনের বহু লেখা অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত অবস্থায় পড়ে আছে। সেই লেখাগুলো সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে পারলে তাদের দু’জনকে ভালভাবে চেনা-জানার সুযোগ পাবে পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকেরা।
এই দুই বন্ধুর হাতের লেখাও ছিল একই রকম সুন্দর। কথা বলতেন শুদ্ধ উচ্চারণে, বানান ও শব্দ ব্যবহারে ছিলেন যত্নশীল।