
ছবি: প্রতীকী
সকালটা কেমন যাবে, তার ভিত্তি তৈরি হয় আসলে আগের রাতেই। আমরা অনেকেই ভেবে নিই সকালের কাজ সকালে করলেই যথেষ্ট, কিন্তু একজন প্রোডাক্টিভ মানুষের দিন শুরু হয় রাতে, ঘুমানোর ঠিক আগের মুহূর্তে। যারা সকালকে ফলপ্রসূ করতে চান, তাদের জন্য রাতের কিছু অভ্যাস বদলে ফেলাই হতে পারে সফলতার চাবিকাঠি।
প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঘুমের সময়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টা গভীর ঘুমের প্রয়োজন হয়। ঘুম কম হলে শরীর ক্লান্ত থাকে, মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়, এবং দিনের শুরুতেই ক্লান্তি গ্রাস করে নেয়। অনেকেই রাত জেগে কাজ করার মধ্যে ‘প্রোডাক্টিভিটি’ খুঁজে পান, কিন্তু সেটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা প্রয়োজন। এটি শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম বা জৈব ঘড়িকে স্থিতিশীল করে এবং সকালে সহজে ঘুম ভাঙতে সাহায্য করে।
রাতের খাবারও প্রভাব ফেলে সকালে কেমন লাগবে তার ওপর। ভারী ও মসলাদার খাবার রাতে খেলে হজমে সমস্যা হয় এবং ঘুম বিঘ্নিত হয়। ফলে পরের দিন সকালে ক্লান্তি অনুভব হয়। তাই রাতের খাবার হওয়া উচিত হালকা, পুষ্টিকর এবং ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে খাওয়াটা ভালো। এতে হজমের জন্য শরীর যথেষ্ট সময় পায়, এবং ঘুম হয় নিরবিচারে।
প্রযুক্তির ব্যবহারও রাতের সময় নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অনেকেই ঘুমানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপে চোখ রাখেন। কিন্তু স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন নামক ঘুম-উদ্দীপক হরমোনের নিঃসরণে বাধা দেয়। ফলে ঘুম আসতে দেরি হয় এবং ঘুমের মান খারাপ হয়। অন্তত ৩০ মিনিট আগে স্ক্রিন বন্ধ করে চোখ ও মনকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। এই সময়টাতে বই পড়া, হালকা ধ্যান বা নিজের দিনটি নিয়ে রিফ্লেকশন করা যেতে পারে।
আরও একটি কার্যকরী অভ্যাস হলো “আগামী দিনের পরিকল্পনা” করে রাখা। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আগামী দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো লিখে ফেললে সকালে সময় নষ্ট হয় না। একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই বোঝা যায়, কোন কাজটা আগে করতে হবে, কোনটা পরেও চলবে। এমনকি পরের দিনের পোশাক, ব্যাগ বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগেই গুছিয়ে রাখলে সকালে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। এতে মানসিক চাপ কমে এবং সকালের কাজ আরও স্মুথলি করা যায়।
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা হালকা মেডিটেশনও হতে পারে এক অনন্য উপায়। রাতের ব্যস্ততা শেষে মনকে শান্ত করা দরকার। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে ধ্যান করলে মন ফ্রেশ হয়, ঘুম ভালো হয় এবং পরদিন সকালে মন ভালো থাকে। বিশেষত যাদের মানসিক চাপ বেশি বা ঘুমের সমস্যা আছে, তারা এই অভ্যাসে উপকার পাবেন।
রাতের সময়টা শুধু শরীরের বিশ্রাম নয়, মানসিক বিশ্রামেরও সময়। তাই এই সময় অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা, তর্ক বা নেতিবাচক আলোচনা এড়িয়ে চলা উচিত। অনেকে রাতে অফিসের কাজ বা ব্যক্তিগত সমস্যায় এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে মানসিক অস্থিরতা ঘুমের পথ আটকে দেয়। তাই রাতে অন্তত এক ঘণ্টা সময় রাখা উচিত একান্ত নিজের জন্য—যেখানে আপনি নিজের সঙ্গে সময় কাটাবেন, নিজেকে বুঝবেন, কিংবা প্রিয় কিছু করবেন যা মনকে শান্ত করে।
রাতের রুটিনে নিয়মিত শরীরচর্চা যুক্ত করা একটি ভালো অভ্যাস, তবে তা ঘুমানোর সময়ের খুব কাছাকাছি হলে ঘুমে বিঘ্ন ঘটতে পারে। সন্ধ্যার দিকে হালকা হাঁটা বা যোগব্যায়াম শরীরকে রিল্যাক্স করতে সাহায্য করে এবং রাতে ভালো ঘুমের সুযোগ তৈরি করে।
পানির অভাবও ঘুমে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ঘুমানোর একেবারে আগে বেশি পানি পান করলে রাতের মাঝখানে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাই দিনভর পর্যাপ্ত পানি খাওয়া জরুরি এবং রাতে ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে এক গ্লাস পানি পান করলেই যথেষ্ট।
রাতের রুটিনে বই পড়া একটি চমৎকার অভ্যাস হতে পারে। এটি মনকে শান্ত করে, ঘুম সহজ করে এবং জ্ঞানের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করে। তবে অবশ্যই হরর বা থ্রিলার জাতীয় বই এড়িয়ে চলা উচিত যদি আপনি ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে যান।
সবশেষে, কৃতজ্ঞতার অনুভব নিয়ে দিন শেষ করা গেলে সকালে উঠে মন অনেক শান্ত ও ইতিবাচক থাকে। প্রতিদিন রাতে নিজের জীবনের ছোট ছোট ভালো দিকগুলোর কথা মনে করে তিনটি কৃতজ্ঞতা লিখে রাখা যেতে পারে। এটি মনকে শান্ত করে এবং ঘুমের আগে একটি পজিটিভ মানসিক অবস্থা তৈরি করে দেয়।
এই ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো যদি রাতের রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে সকালটা শুধু প্রোডাক্টিভই নয়, মানসিকভাবে শান্ত, কর্মক্ষম ও ফোকাসডও হবে। জীবনে ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমেই বড় অগ্রগতি সম্ভব। আর সেই অগ্রগতির প্রথম ধাপ হতে পারে— একটি সচেতন রাতের রুটিন।
এম.কে.