ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

১১ মাসে চার হাজারের বেশি নেতাকর্মী বহিষ্কার

বিএনপি বিব্রত, থামছে না উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ১২ জুলাই ২০২৫

বিএনপি বিব্রত, থামছে না উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা

থামছে না বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা। ১১ মাসে চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কারের পরও প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটছে। কঠোর নজরদারির অভাবে একের পর এক অঘটন ঘটেই যাচ্ছে। সর্বশেষ চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে দেশের গন্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে বিএনপি চরম সমালোচনার মুখে। এসব কারণে বিএনপি এখন বিব্রত বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। 
উল্লেখ্য, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি হাইকমান্ড যখন এ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে ব্যস্ত ঠিক এমনই এক সময়ে দলের কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। ঘটনা ঘটার সঙ্গেই অভিযুক্তদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। তবে ঘটনা ঘটার আগে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাই দিনকে দিন এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েই চলছে। 
এ বিষয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, এত বড় একটি রাজনৈতিক দলের সব নেতাকর্মী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে খবরাখবর রাখা দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষে সত্যিই কঠিন। তবে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নজরদারির মাধ্যমে কে কি করছে তা দেখে আগেভাগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা করছে না বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্য বিএনপি অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। 
সূত্র মতে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ যাবত বিএনপি থেকে যে চার সহস্রাধিক নেতাকর্মী সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার দায়ে বহিষ্কার হয়েছে তাদের মধ্যে সিংহভাগই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী। তবে বিএনপি এ ঘটনাগুলোকে হাল্কা করে দেখছে না। 
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, এত বড় দলের তৃণমূল পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কোনো অঘটন ঘটালে তা আগে থেকে জানা সবসময় সম্ভব হয় না। কখনো কখনো আগে জানা গেলে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়। তবে যারাই বিশৃঙ্খলা করছে তাদেরই দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের পর অভিযোগের সত্যতা পেয়ে সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। আরও কারও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদেরও বহিষ্কার করা হবে। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ ঘটনার নিন্দা ও বিচার দাবি করা হয়েছে। তারপরও এ বিষয়ে সব নেতার জনে জনে কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। 
অভিজ্ঞ মহলের মতে, যখনই কোথাও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে তখনই বিএনপির টনক নড়ে। আগে থেকে সাবধান থাকলে বা এসব ঘটনা যারা ঘটাতে পারে তাদের বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকলে দলকে এই বদনাম বহন করতে হতো না। তবে সারাদেশের সর্বস্তরে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার এখনো সময় আছে। তা না হলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে চড়া মাশুল দিতে হবে। 
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্টের পর থেকেই সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটাতে থাকে। লন্ডন থেকে তারেক রহমানও এ বিষয়টি জানতে পারেন। আর এ জন্যই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগের দিন ৭ আগস্ট নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত বিশাল সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কেউ বিশৃঙ্খলা করে দলের বদনাম করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি ওইদিন আরও বলেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া বিএনপির জন্য অত সহজ হবে না। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে, তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে। 
কিন্তু তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশের পরও বিএনপির কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী বেপরোয়া আচরণ বন্ধ করেনি। তারা একের পর এক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটাতেই থাকে। বাজার, মার্কেট, বাসস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, শিল্পকারখানা, ক্লাব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল, মাস্তানি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অঘটন ঘটাতেই থাকে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে দল থেকে  বহিষ্কার করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা ততই বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি জনমানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে এবং যথোপযুক্ত জবাব দিতে না পেরে বিব্রত হচ্ছে।  
জানা যায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাণিজ্যসহ বিশৃঙ্খলার অভিযোগে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে ১১ মাসে ৬ হাজারের মতো নেতাকর্মীকে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয়। এর মধ্যে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বহিষ্কার করা হয় ৪ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে এ অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নেওয়া হচ্ছে সাংগঠনিক শাস্তির ব্যবস্থা। ছাড় দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই। তারপরও কাজ না হওয়ায় বিএনপি হাইকমান্ড হতাশ বলে জানা যায়। 
সূত্র মতে, বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কারও বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয়। এর পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত তদন্ত কমিটি দ্রুত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তদন্ত রিপোর্ট পাঠায়। রিপোর্টের ভিত্তিতে দলের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির মুখপাত্র ও দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বহিষ্কারের কথা সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রেরিত প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বহিষ্কারের খবর জানিয়ে দেওয়া হয়। গুরুতর অভিযোগ থাকলে কখনো কখনো অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। 
অভিজ্ঞ মহলের মতে, দীর্ঘ ১৯ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলের নেতাকর্মীরা মামলা-হামলাসহ বিভিন্নভাবে তৎকালীন সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকে নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়ায়। এ পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের পর দেশে বিএনপির জন্য অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসে। আর এই সুযোগে বিচ্ছিন্নভাবে দলের কিছু নেতাকর্মী বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে যায়। যদিও দলীয় হাইকমান্ড তাদের কাউকে ছাড় দেয়নি। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলার তেমন অভিযোগ না থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিএনপি হাই কমান্ডকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, থানা, জেলা ও মহানগরে পর্যবেক্ষণ কমিটি করে উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঘটনা ঘটার আগেই যেন তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা নাহলে সামনের দিনে বিএনপির রাজনীতি চরম সংকটে পতিত হবে।

 

প্যানেল/মজি

×