ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

‘সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফল!’

বাংলাদেশে ভারতীয়দের ঠেলে দেওয়ার সমালোচনা করলেন দিল্লির মানবাধিকার কর্মীরা

মীর্জা মসিউজ্জামান

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ১২ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২৩:৫২, ১২ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশে ভারতীয়দের ঠেলে দেওয়ার সমালোচনা করলেন দিল্লির মানবাধিকার কর্মীরা

নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে এক প্রকার জোর করে ভারতে বসবাসকারী মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম কারণ প্রতিশোধ গ্রহণ হিসেবেই দেখছেন খোদ ভারতীয় বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা। ভারতীয়দের দাবি, পশ্চিমারা যদি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ভারতীয়দের দেশে ঠেলে দিতে পারে ভারত কেন  তাদের দেশে থাকা প্রবাসীদের বিশেষ করে মুসলিমদের ঠেলে দিতে পারবে না। কেউ কেউ আবার মুসলিমরা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেন।
অবশ্য বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা এভাবে ঠেলে পাঠানোকে সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফল বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, ভারত বাংলাদেশকে সম্ভাব্য যতদিক থেকে চাপে রাখা যায় ততদিকে থেকেই চাপে রাখার চেষ্টা করবে। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর দু’দেশের সম্পর্কের টানাপোড়ন অন্যতম কারণ। তাদের মতে কূটনৈতিক সম্পর্ক তো আর দু-এক বছর বা পাঁচ বছরে শেষ হয়ে যাবার নয়। ভারত যা করছে তা কোনো মতেই ঠিক নয় বলেও মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কে ইদানীং যে ধরনের শীতলতার আভাস দেখা যাচ্ছে এবং দুই দেশ পরস্পরের নানা ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা বাতিল করে দিচ্ছে, সীমান্তে নিয়মবহির্ভূত ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এটা তারই ধারাবাহিকতা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (আইআর) অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গত কয়েক দশকে এমন আচরণ হয় নাই। হঠাৎ করে এভাবে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘একটি দেশের সরকার পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন যোগ্য নয়।’ ‘পুশ ইন ‘পুশ ব্যাক’ আগেও ছিল। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে তা কোনো ভাবেই ঠিক হচ্ছে না। বাংলাদেশে ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট রয়েছে এই জন্য এমন করতে হবে সেটা কেন? ভবিষ্যৎতে পরিবর্তন হবে ভারতও তো সরকার পরিবর্তন হবে তাই বলে এভাবে একটি দেশের  লোকদের আরেক দেশে ঠেলে দিতে হবে তা কাম্য নয়। ভারত কোনোভাবেই কাজটি ঠিক করছে না।’ 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, ভারত বাংলাদেশকে চাপে রাখতেই এ কাজ করছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের শীথিলতাই এ জন্য দায়ী।
সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের আরও কূটনৈতিকভাবে সত্বর সমাধানের দিকে এগোতে হবে।  সংকটময় পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে সমাধান না হলে পরবর্তীতে করে তেমন ফল আশা করা যায় না। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাইনুল আহসান জনকণ্ঠকে বলেন,  ভারত আইনের তোয়াক্কা না করে এভাবে মুসলমানদের ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত এ সকল বিষয়ে সুস্পষ্ট সমাধান চাওয়া। না হয় যতদিন যাবে তত সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
সিনিয়র এ অধ্যাপক আরও বলেন, বর্তমান সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষায় যেভাবে কূটনৈতিক পলিসি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা প্রতিবেশী দেশের জন্য চিন্তার কারণ।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে অপপ্রচার চালানোর বিষয়ে বারবার সতর্ক করে বাংলাদেশ। ভারতে বসে বিভিন্ন ইস্যুতে শেখ হাসিনা বক্তব্য শুরু করার পর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। 
এ ব্যাপারে ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, যে কারণেই হোক ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক টানাপোড়েন সীমান্ত বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, ট্রানজিট বন্ধ করার ঘটনায় প্রতিটি স্থলবন্দরে বাণিজ্যের গতি কমে গেছে। বাংলাদেশিদের জন্য কার্যত ভিসা বন্ধ রেখেছে ভারত।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, দ্বিপক্ষীয় শীতলতা দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিমসটেক সম্মেলনে ইউনূস-মোদি বৈঠকও উত্তেজনা কমাতে পারেনি। সাউথ এশিয়া মনিটরে ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত ওই নিবন্ধে তিনি বলেছেন, সম্পর্ক উষ্ণ না হলে  কোনো সম্পর্কই পুরোপুরি কাজে আসবে না।
খোঁজ নিয়ে  জানা য়ায়, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ভারত যে অন্তত বেশ কয়েক হাজার সন্দেহভাজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে গোপনে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু রোহিঙ্গা মুসলিমকেও ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আন্দামান সাগরে নামিয়ে দিয়ে মিয়ানমারের দিকে সাঁতরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে-এমন ঘটনাও ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ভারত যে এই পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, রীতিনীতি ও সনদের লঙ্ঘন। বিশেষজ্ঞরা সবাই প্রায় তা নিয়ে একমত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দিল্লি, রাজস্থান, জম্মু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা বা কর্নাটকের মতো বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সন্দেহ হলেই ঢালাওভাবে আটক করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। এসব ভারতের  সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ রাতে বা বন্দুকের মুখে এদের ঠেলে দিচ্ছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ এয়ারক্রাফট এরকম ২৫০ জন নারী-পুরুষকে গুজরাটের ভাদোদরা থেকে এয়ারলিফট করে উত্তর-পূর্ব ভারতে এনে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে ভারতীয় মিডিয়া রিপোর্ট করেছে।
সাউথ এশিয়া হিউম্যান রাইটস ডকুমেন্টেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক রবি নায়ার বলেন, অনেকটা যেন ভারত সরকার এই লোকগুলোকে সোজা কিডন্যাপ করে বর্ডারে নিয়ে এসে নো ম্যানস ল্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে নিজস্ব রীতিনীতি রয়েছে সেটাও ভারত মানছে না।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব ও ভারতের লেখক ও মানবাধিকার আইনজীবী নন্দিতা হাকসার বলেন, বাংলাদেশ যে তার আলাদা একটা দুর্বলতা, সেটা তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে একাধিকবার বলেছেন এবং এই মুহূর্তে যেভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অসহায় নারীপুরুষদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।‘ 
তিনি বলেন, মানবাধিকার নিয়ে যত আন্তর্জাতিক আইন আছে ভারত তা মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে, এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নির্বাহী কমিটিতেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব আছে।‘ তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে শুধু নাগরিকদের নয়, ভারতের সংবিধান কিন্তু এই অধিকার ভারতের ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষকে দিয়েছে। ভারতীয় ভূখণ্ডে একবার অবৈধভাবেও যদি কেউ প্রবেশ করে থাকেন তারপরও তার কিছু কিছু অধিকার থাকে, যেগুলো এখানে প্রয়োগ করার সুযোগই তাকে দেওয়া হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘একটা দেশের অবশ্যই অধিকার আছে তার দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের বের করে দেওয়ার কিন্তু সেই সঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দেন তার একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রীতিনীতি আছে, নিয়ম-কানুন বা প্রোটোকল আছে।’
তিনি স্বীকার কলেছেন, গত কয়েক মাসে ভারত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে যতজনকে আটক করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে, সেগুলোর কোনোটির ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের কাছে তাদের পরিচয় যাচাই বাছাই করতে পাঠানো হয়নি। অথচ নিয়মমাফিক এই ধৃতদের নাম-পরিচয় এবং বাংলাদেশে কথিত ঠিকানা যাচাই করার জন্য সেটা আগে নিকটতম দূতাবাসে পাঠানোর কথা।’
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী আবার বিশ্বাস করেন, বর্ডার দিয়ে এই যে লোকজনকে ঠেলে ফেরত পাঠানো সেটা আসলে বাংলাদেশের জন্য ভারতের একটা বার্তা দেওয়া।
ঢাকায় ভারতের এই সাবেক হাই কমিশনার বলেন, এই জিনিস তো নতুন কিছু নয়, আগেও যখনই দেখা গেছে ঢাকাতে আমাদের প্রতি তত বন্ধুত্বপূর্ণ নয় এমন সরকার আনফ্রেন্ডলি রেজিম ক্ষমতায় এসেছে, তখনই আমরা এ জিনিস করেছি।
শুধু আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা গত ১০ মে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, তার রাজ্য থেকে সম্প্রতি মোট ৩০৩ জন অবৈধ বিদেশিকে ইমিগ্রান্টস ১৯৫০-র আওতায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেটা বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিক্রমে, না কি জোর করে তা তিনি প্রকাশ করেননি।
গত কয়েক মাসে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকেও একাধিকবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নিয়ম আর আইন ভেঙে কেউ যদি ভারতে আসেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবে এঠাই স্বাভাবিক। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং তারা নিজেদের কর্তব্য করে যাবেন।

 

 

প্যানেল/মজি

×