
রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় সারাদেশে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। বুধবারের হত্যাকাণ্ড মর্মষ্পর্শী রূপ পায় শুক্রবার রাতের এক ভাইরাল ভিডিওতে। মানবতার ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর এ ভিডিও দেশবাসিকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টনে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শুক্রবার রাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যায়ে শিক্ষার্থীরা ফেটে পড়েন বিক্ষোভে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে দেওয়া স্লোগানে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় খুনীদের রাজনৈতিক পরিচয় তথা বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদলের বিরুদ্ধেও।
শনিবারও দিনভর বিক্ষোভ চলে সারাদেশে। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল পালন করে কর্মসূচি। দাবি তোলা হয় দ্রুত বিচার আইনে খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। নিহত সোহাগের পরিবার থেকে দাবি করা হয়, খুনীরা এখনো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবারটি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে যুবদল ও ছাত্রদল থেকে চারজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পুলিশ চার আসামিকে রিমান্ডে নিয়েছে। ছাত্রদল নেতা তারেক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছে। নিহত সোহাগকে বরগুণায় গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। পুলিশ এবং স্থানীয় বিএনপি নেতারা সোহাগের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। খুনীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
দেশব্যাপী ভাইরাল হওয়া নৃশংস ভিডিওতে ফুটে ওঠে এক বিভৎস চিত্র। যা দেখে আঁৎকে ওঠে বিবেক। সোহাগ হত্যার ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে থাকা রাস্তায় অর্ধবিবস্ত্র হয়ে শুয়ে পড়ে আছেন সোহাগ। প্রায় নিথর দেহ নিয়ে নড়াচড়ারও উপায় নেই তার। নৃশংস হামলায় তখনো সোহাগের শুধু নিঃশ্বাসটুকু চলছিল। একপাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা সোহাগ তখন মৃত্যুপথযাত্রী। এসময় রাস্তা থেকে একটি বড় কংক্রিটের অংশ হাতে তুলে নেন হাল্কা আকাশি রঙের শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরা রিয়াদ। মাথার ওপরে কংক্রিটের অংশ তুলে সজোরে কোমর আর বুকের মাঝখানে আঘাত করেন তিনি। সোহাগ দুই হাত আর দুই পা ছড়িয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন। এরপর একদম বুক বরাবর আবার আঘাত করলে সোহাগ আবার রাস্তার একপাশে মুখ ফিরিয়ে নেন। তখন টি-শার্ট আর গ্যাবাডিন প্যান্ট পরা সজীব একপাশ থেকে হেঁটে এসে আরেকটা বড় কংক্রিটের অংশ মাথায় তুলে মুখ বরাবর আঘাত করেন। এরপর আরেকটি ইট নিয়ে এসে মাথায় আঘাত করেন ছোট মনির। পাশ থেকে আবার মাথায় আঘাত করেন লম্বা মনির, আর এদের ইট এগিয়ে দেন নান্নু। নৃশংস এই হত্যার ঘটনায় গভীর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন। কেউ কেউ এটাকে আবার ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ শুক্রবার রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পৃথক বিক্ষোভ মিছিল করে। পুরান ঢাকায় বিক্ষোভ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
নৃশংস এ ঘটনায় শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, ঢাকা কলেজ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ইডেন কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে বরগুনা, পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ঝালকাঠি, নাটোর ও লক্ষ্মীপুর জেলাসহ অনেক জেলায় ব্যাপক বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
প্যানেল/মজি