
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসলেও জুলাইয়ের মাঝামাঝি তা দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক এমনকি রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ এর ঘোষণা দেন।
সে সময় বাংলা ব্লকেড চলাকালে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হন। একদিকে পুলিশের বাধা, অন্যদিকে ছাত্রলীগের হুমকি-বাধা সব মিলিয়ে একটু কোণঠাসা হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তবে, সকল বাধা পেরিয়ে একের পর এক নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিতে থাকেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ‘কোটা প্রথা’ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরবেন না।
দেশব্যাপী কোটা সংস্কার আন্দোলন আরও জোরদার করতে ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই ১০ দফা কর্মসূচি দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ‘যেভাবে আন্দোলন পরিচালনা করবেন’ শিরোনামে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে এই নির্দেশনা দেন।
সেই পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, জেলা ও মহানগরে যারা আন্দোলন সমন্বয় করছেন, তাদের সংগঠিত হওয়ার জন্য আলাদা করে সমন্বয়ক কমিটি তৈরি করতে বলা হয়। দল, মত নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে এবং সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি আন্দোলনের স্বার্থে বিতর্কিত বা রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে এ রকম কাউকে নেতৃত্ব পর্যায়ে না রাখার কথাও বলা হয়।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, আন্দোলনকে কোনো একক বা মূল নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল করা যাবে না। সব সময় বিকল্প নেতৃত্ব প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রথম দিকের নেতৃত্বে ঝামেলা হলেও যাতে আন্দোলন স্তিমিত না হয়, নেতৃত্বে নতুন চেহারা আনার চেষ্টা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নির্দেশনায় সমন্বয়ক কমিটি নিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনের কমিটিটা শুধু শৃঙ্খলা রক্ষার। তবে আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়া যাবে না। শান্তিপূর্ণ ও অহিংস এই আন্দোলনে বাইরের কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করে স্যাবোটাজ করতে না পারে, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যে স্থানে কর্মসূচি করা হবে, সেখানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যোগাযোগ করতে চাইলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে সব সিদ্ধান্ত আন্দোলনকারীরাই নেবে। এতে কোনো ধরনের আপোস করা যাবে না।
সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের চেষ্টা করার কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেলা বা মহানগরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে হবে। কারও ওপর কোনো আঘাত বা হুমকি আসলে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে না গিয়ে সামনে এসে কথা বলতে হবে। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। শিক্ষার্থীদের দাবি ও বক্তব্য সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক।
কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে যুক্ত করতেও বলা হয়। জেলা ও মহানগরের নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্মসূচির আগে মাইকিং ও লিফলেটের মাধ্যমে ব্যাপক গণসংযোগ করতে বলা হয়। আন্দোলনকারীদের সংবাদকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এ রকম বক্তব্য বা স্লোগান না দিতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন’ ব্যানার যারা ব্যবহার করবেন, তাদের ঢাকার সঙ্গে আলোচনা করে নিতে বলা হয়। এ ছাড়াও কোনো অনলাইন মিডিয়া ব্যবহার না করে অর্থ সংগ্রহের জন্য সরাসরি ক্রাউড ফান্ডিংয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এদিকে একইদিন কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে পুলিশের যানবাহন ভাঙচুর, হামলা এবং মারধরের অভিযোগ তুলে শাহবাগ থানায় মামলা করে পুলিশ। এতে আরও ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা। প্রতিবাদে এদিন সন্ধ্যায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন’ এর সমন্বয়করা। এ সময় তারা ১৪ জুলাই রাজধানীতে গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। একই সময়ে আন্দোলনে থাকা সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও গণপদযাত্রা করে নিজ নিজ জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে গিয়ে তার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট কর্মসূচিও অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন তারা।
প্যানেল/মজি