ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

ঘুমানোর আগে মানসিক চাপ কমানোর ৭টি কার্যকর উপায়

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১২ জুলাই ২০২৫

ঘুমানোর আগে মানসিক চাপ কমানোর ৭টি কার্যকর উপায়

ছ‌বি: প্রতীকী

বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যস্ততা, কর্মক্ষেত্রের চাপ, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মিলিয়ে মানসিক চাপ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এ চাপ যদি দিনের শেষে কমিয়ে না ফেলা যায়, তবে তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, যার ফলে শরীর ও মনের উপর নেমে আসে আরও গুরুতর প্রভাব। ঘুমের আগে মানসিক চাপ কমানো শুধু বিশ্রামের জন্যই নয়, বরং সামগ্রিক স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য। এখানে কিছু কার্যকর উপায় আলোচনা করা হলো যা প্রতিদিনের ঘুমের পূর্ব মুহূর্তগুলোতে অনুসরণ করলে চাপ অনেকটাই লাঘব হবে।

প্রথমত, শারীরিক বিশ্রাম ও মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট রাতের রুটিন। অনেকেই দিনশেষে হঠাৎ বিছানায় গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু মন তখনও দিনের নানা চিন্তা, ব্যর্থতা কিংবা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় আটকে থাকে। তাই ঘুমানোর আগে অন্তত ৩০ মিনিটের একটি রিল্যাক্সেশন রুটিন তৈরি করুন, যাতে ধীরে ধীরে মন ও শরীর উভয়ই প্রস্তুত হয় ঘুমের জন্য। এর মধ্যে হালকা বই পড়া, ধীরগতির সংগীত শোনা, মৃদু আলো ব্যবহার কিংবা উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এই অভ্যাসটি আপনার মস্তিষ্ককে সংকেত দেয় যে এখন বিশ্রামের সময়।

দ্বিতীয়ত, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ মানসিক চাপ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। গভীরভাবে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে বের করার প্রক্রিয়াটি ৫-১০ মিনিট অনুশীলন করলে শরীরের প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভ অ্যাকটিভ হয়, যা ‘রেস্ট অ্যান্ড রিল্যাক্স’ সিস্টেম হিসেবে কাজ করে। এতে হৃদস্পন্দন ধীর হয়, পেশির টান কমে আসে এবং মন শান্ত হতে শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গভীর শ্বাসের অনুশীলন ঘুমের গুণমান বাড়ায় এবং উদ্বেগজনিত চাপ কমায়।

তৃতীয়ত, স্ক্রিন টাইম বা মোবাইল-কম্পিউটারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা ঘুমের আগে অত্যন্ত জরুরি। স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের নীল আলো মেলাটোনিন নামক ঘুম-উদ্দীপক হরমোনের নিঃসরণ ব্যাহত করে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করার সময় অনেক ধরনের তথ্য আমাদের মনকে উত্তেজিত ও অস্থির করে তোলে, যা ঘুমানোর আগে মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে সব ধরনের স্ক্রিন থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা উচিত।

চতুর্থত, লিখে ফেলুন দিনের ভাবনা বা যেসব বিষয় নিয়ে মন ভারাক্রান্ত—এটিও এক প্রকার থেরাপি। জার্নালিং মানসিক চাপ কমাতে অত্যন্ত সহায়ক। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৫-১০ মিনিট সময় নিয়ে একটি খাতায় লিখে ফেলুন আপনি কী অনুভব করছেন, কী নিয়ে চিন্তিত, বা কী কী ভালো বিষয় ঘটেছে সেদিন। লিখে ফেলার মাধ্যমে মনের ভেতরের অস্থিরতা মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে কাগজে স্থান পায়, ফলে মন তুলনামূলক হালকা অনুভব করে এবং দুশ্চিন্তার প্রভাব কমে আসে।

পঞ্চমত, মেডিটেশন বা ধ্যানচর্চা হলো মানসিক প্রশান্তির অন্যতম কার্যকর উপায়। নিয়মিত ধ্যান করলে মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়ে, যা মেজাজ উন্নত করে এবং চাপ কমায়। ঘুমানোর আগে ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে শুধুমাত্র নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দিন। যদি ভাবনারা আসে, সেগুলোকে দমন না করে মৃদুভাবে আবার মনকে শ্বাসে ফিরিয়ে আনুন। এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে মনকে প্রশিক্ষণ দেয়, যা ঘুমের আগে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনার প্রবণতা কমায়।

ষষ্ঠত, শরীরচর্চা মানসিক চাপ কমাতে অন্যতম সহায়ক, তবে রাতের বেলায় ভারী ব্যায়াম ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই সন্ধ্যার দিকে হালকা হাঁটা বা ইয়োগা অনুশীলন করলে শরীরের মধ্যে জমে থাকা কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ কমে যায়। ইয়োগার কিছু নির্দিষ্ট আসন যেমন ‘শবাসন’ বা ‘চাইল্ড পোজ’ ঘুমের আগে অনুশীলন করলে তা শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও প্রশান্তি আনে।

সপ্তমত, প্রাকৃতিক ঘ্রাণের ব্যবহার বা অ্যারোমাথেরাপিও ঘুমের আগে মানসিক চাপ কমাতে অনেকে উপকারী বলে থাকেন। বিশেষ করে ল্যাভেন্ডার, চ্যামোমাইল বা স্যান্ডালউডের সুগন্ধি তেল ঘরের পরিবেশকে প্রশান্তিময় করে তোলে এবং মস্তিষ্কে রিল্যাক্সেশন অনুভূতি সৃষ্টি করে। একটি ডিফিউজারে এই তেল ব্যবহার করা যায় বা বালিশের পাশে কয়েক ফোঁটা দিয়ে ঘুমানো যেতে পারে।

প্রতিটি উপায়ই আলাদা করে উপকারী, তবে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় যদি এগুলোর মধ্যে কয়েকটি অভ্যাসকে একত্রে জীবনের অংশ করা যায়। প্রতিদিন রাতে একই রকম একটি রিল্যাক্সেশন রুটিন অনুসরণ করলে তা আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরকে একটা নির্দিষ্ট সংকেত দেয় যে এখন বিশ্রামের সময়, আর এই সংকেতেই ধীরে ধীরে মানসিক চাপ কমে আসে। অতএব, শুধু ঘুম নয়, সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ঘুমানোর আগে চাপমুক্ত হওয়া একটি অপরিহার্য অভ্যাস।

এম.কে.

×