
.
দেশি চলচ্চিত্রের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। এক সময় শূটিং, ডাবিং, এডিটিং, প্রিন্ট সবকিছু মিলে এখানকার পরিবেশ ছিল সরগরম। নব্বইয়ের দশকেও সিনেমার বেশিরভাগ কাজ এফডিসিতেই হতো। সে সময় সপ্তাহে পাঁচ-ছয়টি সিনেমার শূটিং হওয়ারও নজির রয়েছে। এখন অনেকটাই জৌলুসহীন, প্রাণহীন, কর্মহীন পরিবেশে পরিণত হয়েছে। শূটিং নেই, নেই অভিনয় শিল্পীদের আনাগোনা। সুনসান নীরবতায় ঘেরা এক পরিবেশ। দিনের বেলা বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের আনাগোনা কিছুটা থাকলেও সন্ধ্যার পর হয়ে ওঠে ভূতুড়ে পরিবেশ। মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচনের সময় কিছুদিন প্রাণ ফিরে পায়। পরে আবারও প্রাণহীন। কালের স্রোতে দেশের চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র এখন এক নীরব সাক্ষী।
এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে এখন ডাবিং বা সাউন্ডের কিছু কাজ করা হলেও সিনেমার শূটিং তেমন হয় না। বেশিরভাগ নির্মাতা সিনেমার কাজ করার জন্য ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন শূটিং স্পট বেছে নেন। অনেকে দেশের বাইরেও চলে যান। মাঝে মাঝে কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ হয়। টেলিভিশনের কিছু অনুষ্ঠানের শূটিংয়ের জন্য মানুষের আনাগোনা হয়। দেশে অসংখ্য বেসরকারি শূটিং স্পট গড়ে উঠেছে। সেসব স্থানে শূটিংয়ের সুবিধা, ক্যামেরা, এডিটিং, এমনকি থাকার সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। ফলে পরিচালক, প্রযোজক এবং নির্মাতারা সেসব স্থানে শূটিং করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাদের মতে, এফডিসিতে কাজ করতে যে টাকা খরচ করতে হয় বাইরের শূটিং হাউসগুলোয় এর চেয়ে কমে সেটা করতে পারেন। এখানে যেমন শিফট হিসেবে পেমেন্ট করতে হয়। দুই শিফট কাজ হলে দুই শিফটের টাকা দিতে হয়, কিন্তু ওসব জায়গায় তারা প্যাকেজ আকারে সুবিধা পান। আবার ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি মিলিয়ে এখানে তাদের যে খরচ পড়ে, বাইরে কাজ করলে এর চেয়ে কমে করতে পারেন। এসব কারণেই এফডিসিতে এখন অনেক নির্মাতা আসতেই চান না। সিনেমা সেন্সরে যাওয়ার আগে এফডিসির একটি ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। তাই সেই ছাড়পত্র নিতেই অনেকে আসেন। অন্যথায় তাদের আসতে দেখা যায় না।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া তেমন কেউ নেই। এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণের শূটিং না থাকায় শিল্পী-কলাকুশলীদেরও পাওয়া যায়নি। তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই, কর্তৃপক্ষ বলছে, ঠিকঠাকভাবেই চলছে বিএফডিসি।
এফডিসির এই প্রাণচাঞ্চল্য বর্জিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে অগ্রজ চলচ্চিত্র পরিচালক ছটকু আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এখন তো ফিল্ম নেই। তাতে করে এফডিসিতে পদচারণা হবে কি করে? আমার একটা ফিল্ম বর্তমানে সেখানেই শূটিং চলছে। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ নামে যে ছবিটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল সেইটা আবার নতুন আঙ্গিকে হচ্ছে। আমি এটার উপদেষ্টা পরিচালক। এর পরিচালক এখন অন্যজন। সেটা নিয়েই চ্যানেল আই এগুচ্ছে। আমরা যারা মূল ধারার ছবি বানাতাম তারা কেউ এফডিসিতে ছবি বানাচ্ছি না। সেখানে একটা ছবি বানাতে গেলে ফাইল নিয়ে ঘুরতে হবে কমপক্ষে এক মাস। এখানে টাকা জমা দিতে হবে, ওখানে বিভিন্ন নথিপত্র জমা দিতে হবে। মোটকথা সিস্টেমের মধ্যে সেখানে কাজ করতে গিয়ে শুধু এখানে-ওখানে ঘুরতে হয়। একটি ছবি বানাতে গেলে অর্থ উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ঘুরতে হবে বিভিন্ন জায়গায়। দেখলাম সেখানে শূটিং করা অনেক ঝামেলার। এখন যারা ছবি বানায় তারা চিন্তা করে বেটার কোথায় ছবির শূটিং করা যায়। মনে করেন এফডিসিতে একটা ক্যামেরা নিতে গেলে কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা জমা দিতে হবে। পরবর্তীতে নিতে গেলে আবার এটা-ওটা করতে হবে। অথচ বাইরে যেখানে কাজ করি, তারা ক্যামেরা পাঠিয়ে দেয়। পরে একটা বিল করে পাঠায়। কিন্তু এফডিসিতে সব নিয়ম আপনাকে আগে করতে হবে। কাজেই এফডিসিতে এখন টোটালি ছবির শূটিং নেই বললেই চলে। আর ছবির ব্যবসা তো নেই। যার জন্য এফডিসি এখন পদচারণায় মুখরিত হয় না। মূলত এফডিসি তো ছবির জন্য। আর ছবি যদি না হয় এফডিসিতে যাবে কে? আমরা যারা বুড়ো হয়ে গেছি তারা পরিচালক সমিতিতে বসে মাঝে-মধ্যে পুরানো দিনের কথাবার্তা আলোচনা করি। কিন্তু ছবি বানানোর যে ইনটেনশন তা খুব কমে গেছে। আপনি যদি ভাবেন সেই সোনালি দিনের মতো পদচারণা দেখবেন তা তো হবে না।
এফডিসিতে কাজ করতে হলে আগে থেকে প্রযোজক সমিতির সদস্য, পরিচালক সমিতির সদস্য হতে হয়। শিল্পী সমিতিও আছে এফডিসিতে। সঙ্গে আরও রয়েছে ১৬টি সংগঠন। এসব সংগঠনের সদস্যরাই এফডিসিকে সরগরম রাখার চেষ্টা করেন প্রায়শই। বিশেষ করে শূটিংহীন এফডিসিতে পরিচালক সমিতি ও শিল্পী সমিতির সদস্যদের বেশি আনাগোনা দেখা যায়। তবে এর মধ্যে শিল্পী সমিতির সদস্য সংখ্যা বেশি বলে তারাই বেশি থাকেন। এরা সবাই অবশ্য তারকা শ্রেণির নন। নির্বাচন নিয়েই এফডিসি থাকে উত্তপ্ত, থাকে মানুষের আনাগোনা। পরিচালক সমিতির নির্বাচন নিয়ে এফডিসি সরগরম থাকলেও সেটা বলা যায় ঝামেলাহীন। পরিচালকরা ভোটের পক্ষকাল আগে থেকে এফডিসিতে আসেন। আড্ডা দেন। নিজেদের পক্ষে প্রচার চালান। নির্বাচন শেষে আবারও তারা নীরব। কিন্তু যত ঝামেলা তৈরি হয় শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে বাগবিতণ্ডা, এমনকি হামলা-মামলাও হয়েছে।
এফডিসির এ কর্মহীনতা বা সুনসান নীরবতা প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির বর্তমান সভাপতি শাহীন সুমনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সবাই বলে এফডিসি আছে, কিন্তু প্রাণ নাই। আমাদের দীর্ঘদিনের পথচলা এফডিসিতেই। এই মুহূর্তে এখানে কাজের গতি নেই বলা যায়। মাঝে মাঝে কেউ কেউ কিছু কাজ করেন। এফডিসি এখন বলা যায় শূন্য বাগান। কিন্তু এটা আমাদের কাম্য না। এফডিসিতে প্রাণচাঞ্চল্য নেই তার কারণ অনেক। প্রধানত দেশে এখন ছবি নির্মাণ তেমন নেই। হল সংকটের কারণে সিনেমাও তৈরি কমে গেছে। অনেকে ঈদকেন্দ্রিক কিছু ছবি বানিয়ে ব্যবসা করেন। এরপর হল আবার বন্ধ হয়ে যায়। যদি হল না থাকে তাহলে টাকা লগ্নি করে সিনেমা বানিয়ে তো দেখাতে পারবে না। সরকারের কছে আমাদের দাবি ছিল প্রত্যেক জেলা শহরে একটি করে সিনেপ্লেক্স তৈরি করা। তাহলে সরকার যে অনুদান দেয় তা দিয়ে সিনেমা বানিয়ে হলে দেখানো সম্ভব। দ্বিতীয়ত এফডিসিতে সিনেমা বানানোর জন্য পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও টেকনিশিয়ানের অভাব। তবে যা আছে তার যদি রেট কমিয়ে দেয় তাহলে কিছুটা কাজ হবে। আমরা ছবি করার সময় দেখেছি আধুনিক যন্ত্রপাতির খুব অভাব। কাজ চালানোর মতো কিছু আছে, সেটাও ভালো মানের না।
মানুষের রুচি বদলেছে এখন। তারা নান্দনিক লোকেশন দেখতে চায়। এক জায়গায় গৎবাঁধা কাজ দেখতে চায় না। তাই নির্মাতারাও লোকেশনে বৈচিত্র্য আনার জন্য বাইরে শূটিং করেন। এ কারণে এফডিসিতে শূটিং নেই বললেই চলে। আর এখানকার কিছু নিয়ম-কানুন তো রয়েছেই, যেগুলো নির্মাতাদের অনুকূলে নয়। তাই এখানে শূটিং হয় না।
এফডিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঝাড়ুদার বলেন, আমি বিএফডিসিতে ৪০ বছরেও অধিক সময় ধরে ঝাড়ুদারের কাজ করে যাচ্ছি। আগের সময় কত জমজমাট ছিল। ভোর থেকেই কত নায়ক-নায়িকা, পরিচালক আসা-যাওয়া করতেন। দেখতেও ভালো লাগত। কিন্তু এখন শূটিং নেই বললেই চলে। চলচ্চিত্র নির্মাণের সেটের কাজ করেন এমন একজন বলেন, আমরা যারা চলচ্চিত্রের সেটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি কাজ কম থাকায় তাদের সংসার চলাটাও দায় হয়ে পড়েছে। শূটিং না থাকায় ক্যান্টিনের কেনাবেচাও কম।
অভিনেতারা বলছেন, লাইট, ক্যামেরা, শূটিং স্পট, ডাবিং, এডিটিংসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ের দাম কমানো হলেই চলচ্চিত্র বাড়বে এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও আসা-যাওয়া করবেন।
এফডিসির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করছেন মাসুমা রহমান তানি। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে তার ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি এফডিসিতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। গত ৩১ মে বিকেলে মানিক মিয়া নামের এক যুবক চাপাতি হাতে এফডিসিতে প্রবেশ করে অতর্কিত হামলা চালায়। সেই হামলার ঘটনার ১০ দিনের মাথায় গত ১১ জুন এফডিসির কালার ল্যাবে চুরির ঘটনা ঘটে। তবে এফডিসির নিরাপত্তারক্ষীরা বিষয়টি টের পেয়ে হাতনাতে ধরেন দুই কিশোর চোরকে। এফডিসির পাশের রেললাইন হচ্ছে মাদকের আখড়া। যে কারণে দেওয়ালের অবস্থা বেহাল থাকায় অনেক ঝুঁকি রয়েছে। যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।