ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

বিরতিহীন কাজ নয়, সঠিক সময়ে লাঞ্চ ব্রেকই বাড়ায় প্রোডাক্টিভিটি

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ৮ জুলাই ২০২৫

বিরতিহীন কাজ নয়, সঠিক সময়ে লাঞ্চ ব্রেকই বাড়ায় প্রোডাক্টিভিটি

ছ‌বি: প্রতীকী

বর্তমান কর্মব্যস্ত যুগে প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য অনেকেই ধরে নেন, বেশি সময় ধরে বিরতিহীনভাবে কাজ করাই সফলতার চাবিকাঠি। বিশেষ করে অফিস সংস্কৃতিতে এমন একটি ধারণা গড়ে উঠেছে যে, বেশি সময় ধরে ডেস্কে বসে থাকা মানেই কর্মীটির দায়বদ্ধতা বা কর্মক্ষমতা বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দীর্ঘ সময় কাজের মাঝে বিরতি না নেওয়া বরং প্রোডাক্টিভিটিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক সময় ও পদ্ধতিতে নেওয়া একটি লাঞ্চ ব্রেক কর্মীর মানসিক প্রশান্তি ও শরীরিক পুনর্জাগরণের সুযোগ দেয়, যা পরবর্তী সময়ের কাজকে আরও ফলপ্রসূ করে তোলে।

বলা হয়ে থাকে, "চালিয়ে যাও, থামলে পিছিয়ে পড়বে"। কিন্তু মানবদেহ কোনো মেশিন নয়। এটি নিরবিচারে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। একটানা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, টানা মিটিং বা কাজের চাপে পড়ে দুপুরের খাবার বাদ দেওয়া কিংবা দ্রুত কোনো কিছু খেয়ে নেওয়া শুধু পেট ভরানোর কাজ করলেও মানসিকভাবে তা কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না। বরং এতে ক্লান্তি, রাগ, অমনোযোগিতা ও শরীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়, যা পুরো দিনের কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। সঠিকভাবে নেওয়া একটি লাঞ্চ ব্রেক শুধু খাবার খাওয়ার সময় নয়, এটি একটি মানসিক পুনরাবৃত্তির সুযোগ। এই সময়টি যদি কাজ থেকে কিছুটা দূরে থেকে নেওয়া যায়, তাহলে মস্তিষ্ক কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম পায়, যা সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে বাড়িয়ে তোলে।

অনেক সময়ই দেখা যায়, যারা লাঞ্চ ব্রেকে ঘরের বাইরের আলো হাওয়ায় কিছুক্ষণ হাঁটেন বা সহকর্মীদের সঙ্গে হালকা গল্প করেন, তারা বিকেলবেলার কাজগুলোতে অনেক বেশি মনোযোগী ও উদ্যমী থাকেন। এ থেকে বোঝা যায়, একটি ছোট বিরতিও কীভাবে পুরো কর্মক্ষমতাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। এটি শুধু মানসিকভাবেই নয়, শরীরিকভাবেও উপকার দেয়। দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকার ফলে যে মাংশপেশির জড়তা ও রক্তসঞ্চালনের সমস্যা দেখা দেয়, তা একটি মাঝারি সময়ের বিরতিতে অনেকাংশেই কাটানো সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দিনের কাজকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করে মাঝেমাঝে বিরতি নেওয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে কাজের মান এবং গতির উন্নতি ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিরতি হচ্ছে দুপুরের খাবার সময়। এটি যেন অফিস ডেস্কে বসে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নেওয়া না হয়, বরং একটি আলাদা জায়গায় গিয়ে মনোযোগ দিয়ে খাওয়া হয় — এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রয়োজনে কর্মক্ষেত্রে আলাদা লাঞ্চ স্পেস বা রিক্রিয়েশন কর্নার রাখা যেতে পারে, যাতে কর্মীরা মানসিকভাবে রিফ্রেশ হওয়ার সুযোগ পান।

অনেকে মনে করেন, কাজ না করে লাঞ্চ ব্রেকে বেশি সময় ব্যয় করলে অফিস কর্তৃপক্ষের চোখে তারা দায়িত্বহীন মনে হবেন। অথচ আধুনিক ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতিতে এখন প্রোডাক্টিভিটিকে শুধু ঘণ্টা দিয়ে মাপা হয় না, বরং ফলাফল ও মানের ওপর জোর দেওয়া হয়। কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ও কাজের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখন অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘মাইন্ডফুল লাঞ্চ’ বা ‘সাইলেন্ট ব্রেক’ প্রবর্তন করছে, যাতে কর্মীরা খাবার গ্রহণের সময় সম্পূর্ণভাবে কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন। এটি তাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা বাড়ায়, খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস উন্নত করে এবং কাজের প্রতি নতুন উৎসাহ তৈরি করে।

বাংলাদেশের মতো দ্রুতগতির আর প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশেও এখন সময় এসেছে অফিস সংস্কৃতিকে মানবিকভাবে নতুন করে ভাবার। একটি ভালো লাঞ্চ ব্রেক শুধু একজন কর্মীর নয়, পুরো টিমের কাজের মান ও পরিবেশ উন্নত করতে পারে। এতে করে কর্মীরা নিজের দায়িত্ব আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং একে নিজের কাজ মনে করে তা সম্পাদনে আগ্রহী হন।

সবশেষে বলা যায়, প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাজের পরিমাণ নয়, কাজের ধরন, সময় ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের প্রয়োজন বুঝে বিরতির সুযোগ দেওয়াও অত্যন্ত জরুরি। সঠিকভাবে নেওয়া একটি লাঞ্চ ব্রেক কর্মজীবনে শুধু মানসিক শান্তিই আনে না, বরং কাজের প্রতি ভালোবাসা ও নিষ্ঠাও গড়ে তোলে। তাই ‘বিরতিহীন কাজ নয়, সঠিক লাঞ্চ ব্রেকই বাড়ায় প্রোডাক্টিভিটি’ — এ কথার গুরুত্ব আমরা যত দ্রুত বুঝতে পারব, ততই কর্মক্ষেত্র হবে আরও মানবিক ও ফলপ্রসূ।

এম.কে.

×