ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

শীতের পিঠার কারিগর

ওয়াজহাতুল ওয়াস্তি

প্রকাশিত: ০১:৩২, ১ ডিসেম্বর ২০২৩

শীতের পিঠার কারিগর

মরিয়ম বেগম

যে চোখ স্বপ্ন দেখে এক হাতে চিতই পিঠার গুঁড়ি ঢেলে দিচ্ছেন মাটির সরায়, অন্য হাতে ভাজছেন তেলের পিঠা। এর মাঝেই আবার দোকানে আসা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের পিঠা। মরিয়ম বেগমের এমন ব্যস্ততা দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি সত্তরের ঘর পেরিয়েছেন অনেক আগেই। ক্যাম্পাসে সবার কাছে পরিচিত ‘পিঠাওয়ালা নানি’ নামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের (জাবি) অমর একুশের পাদদেশে প্রতিদিন বিকেলে পিঠার পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি। আতপ চালের গুঁড়ি প্রস্তুত করা থেকে পিঠা বানানো পর্যন্ত সবই করেন নিজ হাতে।
তিন ছেলে, পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে মরিয়মের সংসার। প্রায় এক দশক আগে হারিয়েছেন স্বামীকে। জীবনের এই পথ-পরিক্রমায় মাড়িয়েছেন নানা বন্ধুর পথ। করেছেন পরিশ্রম। ছুটেছেন একটু সচ্ছলতার দিকে। আর তাতেই শুনেছেন অনেকের অনেক কটুকথা। তাতে কি! নিজের অন্নের যোগান তো নিজেকেই করতে হবে। তাই দমে যাননি। বরং এসব থেকে শিক্ষা নিয়েছেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। ফলস্বরূপ কর্মতৎপর এই নারী এ বয়সেও একাই করছেন পিঠা বিক্রির কাজ। মরিয়ম বলেন, ‘অনেক বছর ধইরা পিঠা বিক্রি করতাছি। সারা বছরই বিক্রি করি। তবে শীত আইলে চিতই আর ভাপাপিঠা যোগ হয়।’
মরিয়মের বয়স বেড়েছে, এখন নাকি কানেও শুনছেন কম। ছেলেরাও হয়েছে কর্মক্ষম। মায়ের কাজে ব্যাপক আপত্তি তাদের। তবে জীবনব্যাপী যুদ্ধ করা এই নারী ছাড়তে পারেননি কর্মতৎপরতা। স্বপ্ন দেখেন আমৃত্যু কাজ করে জীবিকা নির্বাহের। তিনি বলেন, ‘বাড়িত বইয়া থাইক্যা কি করুম? এইহানে বিকালে পিঠা বানাই, নাতিরা আসে, পিঠা খায়, গল্প করে। মনে শান্তি পাই। রোজ হাজারখানেক ট্যাকা ইনকাম হয়। এই ট্যাকা পোলার বৌয়ের হাতে দেই। নাতিগো কিছু কিইন্যা দেই।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে (জাবি) আরেক সংগ্রামী নারী রহিমা বেগম। ক্যাম্পাসের ছবি চত্বরের পশ্চিম কোণে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চা বিক্রি করেন তিনি। বয়স পঞ্চান্ন। চেহারায় ছাপ স্পষ্ট। তবে রহিমা নামে নেই পরিচিতি। ক্যাম্পাসের সবাই ডাকে ভাবি। নব্বইয়ের দশকে স্বামী ও পরিবার নিয়ে ভাগ্যের সন্ধানে এসেছিলেন ঢাকায়। শুরুর দিকে তার স্বামী খুঁজেছে অনেক উপায়-উপায়ক্রম। কোথাও স্বস্তি না পেয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান ভবনের কোনায় একটি ভাসমান চায়ের দোকান দিয়েছিলেন তার স্বামী।
ছোট্ট এই দোকানের আয় দিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। বিপত্তি বাধে প্রায় এক যুগ আগে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন রহিমার স্বামী। হারিয়ে ফেলেন কর্মক্ষমতা। বন্ধ হয়ে যায় আয়-রোজগার। চার সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন এই নারী। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে স্বামীর সেই দোকানেই শুরু করলেন চা বিক্রির কাজ।
শুরুর দিকে পাড়া-পড়শীদের অনেক কথা শুনেছেন। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সহ্য করেছেন সব। তবে সাহস যুগিয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যেকোনো প্রয়োজনে হাত বাড়িয়েছে সাহায্যের। সেই কথা স্বীকার করে এই নারী বলেন, ‘এই বিশ^বিদ্যালয়ের ভাই-বোনগুলা খুবই ভালা। আমারে অনেক সাহায্য করছে। আর ওই সময় এই দোকানে কাজ শুরু না করলে পেটে খাওন জুটতো না। দিনে যা বেচতাম তার লাভ দিয়া চাল-ডাল কিনতাম। এ রকম কইরা কইরা তো ১২ বছরের বেশি হইয়া গেছে।’ সন্তানদের মানুষ করতে হবে। এগিয়ে নিতে হবে পরিবারকে। এজন্য ধৈর্য ও একাগ্রতার সঙ্গে রহিমা চালিয়ে যাচ্ছেন চায়ের দোকানটি। এই দোকান করেই ছেলেকে পড়াচ্ছেন মাস্টার্সে। আর তিন মেয়েকে মাধ্যমিক পাস করিয়েছেন। পাশাপাশি পূর্বে স্বামীর কেনা ছোট্ট একটি জায়গায় বেঁধেছেন টিনশেড ঘর।

এক সময় চা খাওয়ার জন্য ক্রেতারা তার দোকানেই বেশি ভিড় জমাতো বলে জানান তিনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় বিশ^বিদ্যালয়ে দোকানের সংখ্যা বাড়ায় কমেছে ক্রেতা। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে প্রভাব পড়েছে আয়ে। এছাড়া দীর্ঘ এক যুগের ধকলের পর এখন আর শরীরে কাটে না। চান কাজ থেকে অবসর নিতে। রহিমা বলেন, ‘পোলাডার পড়ালেখা শেষ হইয়া যাইবো কিছুদিনের মধ্যে। একটা ভালো চাকরি পাইলে আর কাজ করুম না। শরীরডা এখন আর আগের মতো চলে না।’

×