
ছবি: সংগৃহীত
২৬ এপ্রিল ১৯৮৬। ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ বদলে দেয় পৃথিবীর ইতিহাস। রিঅ্যাক্টর নম্বর ৪-এ ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর পারমাণবিক বিপর্যয়। এক রাতেই একটি সমৃদ্ধ শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
সেই রাতে পরীক্ষামূলকভাবে বন্ধ করার কথা ছিল চতুর্থ রিঅ্যাক্টরটি। কিন্তু একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই আকাশে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয়তা, যার মাত্রা হিরোশিমার পারমাণবিক বোমার চেয়েও বহুগুণ বেশি। প্রথমে আগুন নেভাতে আসে ফায়ার ব্রিগেড। কিন্তু তারা জানত না তারা কীসের মুখোমুখি। ধীরে ধীরে পুরো চেরনোবিল অঞ্চল ও আশপাশের শহর প্রিপিয়াত হয়ে পড়ে বিষাক্ত। ৩৬ ঘণ্টা পর শুরু হয় লোকজনকে সরানোর কাজ। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রিপিয়াত শহর বিশেষভাবে পারমাণবিক প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের আবাসনের জন্য। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শহরে ছিল আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা হাসপাতাল, থিয়েটার, স্কুল, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, সুইমিং পুল, দোকানপাট।
বিস্ফোরণের সময় প্রিপিয়াত শহরে বসবাস করছিল প্রায় ৫০,০০০ মানুষ। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই শহরটি হয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মুখোমুখি। কিন্তু প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য না দেওয়ায় স্থানীয় মানুষজন বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতে পারেননি। অনেকেই স্বাভাবিক জীবনের মতো ঘোরাফেরা করছিলেন, বাচ্চারা খেলছিল রাস্তায়। বিস্ফোরণের প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পরে হঠাৎ করেই শহরবাসীদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ আসে। বলা হয়েছিল, "তিন দিনের জন্য শহর ছেড়ে যেতে হবে।" কিন্তু সেই যাত্রা আর ফেরা হয়নি কারো। ফেলে যাওয়া কাপড়, খেলনা, ওষুধ, বই সবই থেকে গেছে স্মৃতি হয়ে।
প্রিপিয়াত আজ পরিণত হয়েছে এক নিঃসঙ্গ ভূতের শহরে। হাসপাতালের ওয়ার্ডে পড়ে আছে রোগীদের পোশাক, শ্রেণিকক্ষে খোলা বই, দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার থেমে আছে ১৯৮৬ সালেই। মনে হয় যেন কেউ হঠাৎ করে উঠে চলে গেছে, ফেরা হয়নি আর।
চেরনোবিলের পারমাণবিক বিপর্যয়ের প্রভাব সবচেয়ে দ্রুত ও গভীরভাবে পড়েছিল প্রিপিয়াত শহরে। যে শহর পারমাণবিক শক্তিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল, সে শহরই হয়েছিল সেই শক্তির ধ্বংসের প্রথম শিকার।
নির্মূল ও ধামাচাপার চেষ্টা: সোভিয়েত সরকার প্রথমে ঘটনাটি গোপন রাখতে চেয়েছিল। কয়েকদিন পর গোটা ইউরোপে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি প্রকাশ পায়। প্রায় ৬ লাখ "লিকুইডেটর" নিয়োগ দেওয়া হয় তেজস্ক্রিয় ধ্বংসাবশেষ সরানোর জন্য। অনেকেই সরাসরি বিকিরণে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, অনেকেই পরবর্তী বছরগুলোতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
তাদের জীবন ইতিহাসে লেখা হয়নি বড় অক্ষরে, কিন্তু তাঁদের ত্যাগে চেরনোবিলের আরও বিস্তৃত বিপর্যয় রোধ হয়েছিল। রিঅ্যাক্টরের চারপাশে নির্মাণ করা হয় 'সারকোফ্যাগাস' বিশাল কংক্রিটের আবরণ, যা ধ্বংসাবশেষকে আড়াল করে রাখে। এরপর ২০১৬ সালে একটি নতুন কাঠামো নির্মাণ করে সেটিকে ঢেকে দেওয়া হয়।
আজ চেরনোবিল এক পর্যটন কেন্দ্র যা কৌতূহলী মানুষের চোখে রহস্য, ইতিহাস ও মানবিক বিপর্যয়ের জীবন্ত নিদর্শন। পর্যটকরা নির্দিষ্ট নিরাপদ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেন গাইডের সাথে। স্কুলের শ্রেণিকক্ষ, ফাঁকা হাসপাতাল, ভাঙা রোলার কোস্টার ও প্রিপিয়াতের বিখ্যাত ফেরিস হুইল যেন থেমে থাকা সময়ের ঘড়ি।
২০১৯ সালে এই স্থানের ওপর নির্মিত HBO-র 'Chernobyl' সিরিজ বিশ্বব্যাপী বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং চেরনোবিল ট্যুরিজম বেড়ে যায় দ্বিগুণ। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ২০২২ থেকে অঞ্চলটি আবার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
চেরনোবিল আমাদের শেখায় মানবিক ভুল ও প্রযুক্তির অতি আত্মবিশ্বাস কীভাবে লাখো মানুষের জীবনে বিষ ঢালতে পারে। এটি কেবল একটি শহরের ধ্বংসের গল্প নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান ও নৈতিকতার ভারসাম্য না থাকলে প্রযুক্তির হাতেও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।
চেরনোবিল সেই ইতিহাস, যা এখনও নিঃশব্দে কান্না করে ধ্বংসস্তূপের মাঝে।
Mily