
মহেষখালীর কালারমার ছড়ার বাদশা মিয়ার ছেলে শহীদ তানভীর সিদ্দিকীর (ইনসেটে) বসতবাড়ি
বৃষ্টিস্নাত বিকেলের হাল্কা বাতাসে ভেসে আসছিল এক নিঃশব্দ কান্না। চারপাশে ছিল নিস্তব্ধতা, আর সেই নিস্তব্ধতার মাঝেই কাঁপছিল একটি হৃদয়, ফেটে যাচ্ছিল একটি বুক। অশ্রু শুধু চোখ থেকে পড়ছিল না, গড়িয়ে যাচ্ছিল বুকের গভীর থেকে উঠে আসা হাহাকার হয়ে। সেই কান্না এক অসহায় পিতার। বাদশাহ মিয়া, যিনি হারিয়েছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান তানভীর সিদ্দিকীকে।
‘সন্তান একদিন বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে সে স্বপ্নে বিভোর ছিল গোটা পরিবার। সেই স্বপ্নটাই আজ বুকের ভেতর কবর হয়ে আছে।’ এই বাক্য উচ্চারণ করতে করতেই গলা ধরে আসে তাঁর। চোখের কোণে জমে থাকা জলের কণা তখন শুধুই জল নয়, বরং তা ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, বঞ্চনার দলিল, আর ভেঙে যাওয়া ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি।
তানভীর সিদ্দিকী ছিলেন মহেষখালীর কালারমার ছড়ার এক দরিদ্র ঘরের সন্তান। একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা এই তরুণ পড়তেন চট্টগ্রামের সরকারি আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজে। এইচএসসির ধাপ শেষ হলে হয়তো একটি চাকরি খোঁজা শুরু হতো, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি। কিন্তু সেই সব সম্ভাবনার আগেই সব থেমে গেল ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই।
টগবগে তরুণ তানভীর শুধু নিজে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই বাঁচছিলেন না, তাঁর হৃদয়ে ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা। তিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন, রক্তাক্ত জুলাইয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন, যে কর্মসূচি ডাক দিয়েছিল বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ। উদ্দেশ্য ছিল কোটা সংস্কার, শিক্ষা ও সুযোগের বৈষম্য দূর করা।
তানভীর সেই আন্দোলনের সামনের সারির একজন ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন তাদেরই একজনÑ যারা নির্যাতনের ভয়ে নত না হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।২০২৪ সালের ১৮ জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালীন বিকেল ৪টা নাগাদ চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকায় শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিলেন। তানভীরও সেখানে ছিলেন, বজ্রকণ্ঠের প্রতিবাদ আর চোখে আগামীর স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন করছিলেন।
বহদ্দারহাটের আকাশে হঠাৎ বেজে ওঠে গুলির শব্দ। ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ একসঙ্গে চড়াও হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। স্লোগানের জায়গায় তখন শুধুই ছিল আতঙ্কের চিৎকার, হতভম্ব দৌড়, আর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর। তানভীরের শরীরেও লাগে গুলি। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। একজন সম্ভাবনাময় তরুণ, যিনি হয়তো আগামী দিনে একজন সমাজসেবক, প্রশাসক বা শিক্ষক হতেন, তিনি সেদিনই থেমে গেলেন চিরতরে।
বাদশাহ মিয়া, তানভীরের বাবা, একজন পান বিক্রেতা। জীবনের প্রায় প্রতিটি দিন কাটিয়েছেন রোদ-বৃষ্টিতে পানের ঝুপড়ি নিয়ে। তাঁর জীবনে কোনো বিলাসীতা ছিল না, ছিল শুধুই সন্তানদের জন্য স্বপ্ন। জীবনযুদ্ধে হেরে না গিয়ে, পানের বরজে কাজ করে সংসার চালান তিনি। সমস্ত উপার্জনের প্রায় পুরোটাই খরচ করতেন ছেলের পড়াশোনায়।
‘নিজে না খেয়ে থেকেছি, কিন্তু ছেলেকে খাইয়ে পড়িয়েছি। পানের টাকায় বই-খাতা কিনেছি, ছেলের মুখে হাসি দেখার জন্যই বেঁচে ছিলাম’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন তিনি। তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পান বিক্রেতা বাদশা মিয়া। তিনি বলেছিলেন ‘ছেলের লাশের টাকা আমার গলা দিয়ে নামবে না’। তানভীরের মা আজও সন্ধ্যায় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মনে হয়, ছেলে হয়তো হেঁটে এসে বলবে, ‘মা, আমি এসেছি।’ কিন্তু তিনি জানেন, সেই প্রতীক্ষা আর কোনোদিন শেষ হবে না। সন্তানের শোকে বিহ্বল বাদশা মিয়া ও তাঁর পরিবার ২৯ জুলাই ২০২৫ তারিখ প্রতিবেদককে এ কথা বলেন।
২০১৩ সালে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের বসতভিটা পুড়িয়ে দেয়। রাতের আঁধারে ঘরছাড়া হয় গোটা পরিবার। এরপর থেকে শ্বশুরবাড়ির একটি কুঁড়ে ঘরে উঠেছিলেন। কুঁড়ে ঘর বললে ভুল হবে, এটি একটি ঝুপড়ি যার অর্ধেক খোলা। রোদের দিনে রোদ, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি আর শীতকালে ঠান্ডা হিম হাওয়ায় জমে তাদের শরীর। সে ঘরের পরিবর্তন হয়নি এখনো। আগের মতো সেই ঝুপড়ি ঘরেই মানব্রে জীবন-যাপন করছেন শহিদ তানভীরের অসহায় পরিবার। রাতে শান্তিতে একটু ঘুমানোর জন্য একটি ঘরের আশায় ঘুরছেন উপজেলা, জেলা অফিসে কিন্তু এখনো পায়নি কোন চুড়ান্ত ফলাফল।
তানভীর সিদ্দিকী কেবল একজন ছাত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন পরিবর্তনের প্রতীক। তাঁর মৃত্যু একটি প্রজন্মের কণ্ঠরোধ, একটি সম্ভাবনার হত্যাকা-। রাষ্ট্র যদি তার এমন সন্তানের মৃত্যুতে নীরব থাকে, তবে সেই নীরবতা নিজেই এক অপরাধ। আজ প্রশ্ন উঠে-তানভীরের মতো যারা স্বপ্ন দেখে, যারা প্রতিবাদ করে, তারা কি রাষ্ট্রের চোখে কেবলই সংখ্যা? তাদের রক্ত কি পাতার নিচে হারিয়ে যাওয়া অক্ষর?
নাকি সেই রক্তেই লেখা হবে ভবিষ্যতের সুবিচারের সংবিধান?শহীদ তানভীরের মৃত্যু কেবল এক পরিবারের হৃদয়বিদারক বেদনা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ব্যর্থতা, একটি সমাজের নৈতিক পতনের প্রতিচ্ছবি। যদি তানভীরের রক্ত ন্যায়বিচারের পথে পুষ্প না হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্র সুবিচারের দাবিদার হতে পারে না।
ইতিহাসের পাতায় তানভীর সিদ্দিকী এখন আর শুধু একটি নাম নয়, তিনি এক প্রতীক, এক প্রশ্ন, এক জেগে থাকা বিবেক। তাঁর মৃত্যু নয়, তাঁর আদর্শ হোক আগামী প্রজন্মের পথে আলো। নইলে এই ভূখ- হারাবে আরও তানভীর, হারাবে তার ভবিষ্যৎ।
প্যানেল হু