
ছবিঃ সংগৃহীত
যখন দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি, তখন কেউ পাশে দাঁড়াল না
হিউস্টনের একটি বসন্তের সকাল। টেক্সাস সিভিল রাইটস প্রজেক্ট-এর আইন পরিচালক ডাস্টিন রিন্ডার্স ফোন হাতে একটার পর একটা বড় বড় আইন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ট্রাম্প সরকারের ইমিগ্রেশন ধরপাকড়ের শিকার মানুষদের আইনি সহায়তা দিতে হবে।
আগে যারা সাহায্যে এগিয়ে আসত, এবার সবাই একে একে "না" বলছে।
রিন্ডার্স হতাশ হয়ে বলেন, “এখন আমরা নিজেরাই সব মামলা সামলাচ্ছি। আগে এসব কাজে অনেক ফার্ম সাহায্য করত, এখন কেউই আর এগিয়ে আসে না।”
হঠাৎ এমন কী ঘটল?
২০২৫ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকেই বড় বড় আইনজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করেন।
তিনি একাধিক নির্দেশনা (Executive Order) জারি করে এমন আইন সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন যারা ইমিগ্রেশন, ট্রান্সজেন্ডার অধিকার, বা ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলার মামলাগুলোতে প্রো-বোনো (বিনা পারিশ্রমিকে) আইনি সহায়তা দিয়েছে।
ট্রাম্পের মতে, এসব কাজ রাষ্ট্রবিরোধী।
ফলাফল?
আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো ভয় পেয়ে পেছিয়ে যাচ্ছে।
অনেকে বলছে— যদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, তাহলে কর্পোরেট ক্লায়েন্ট হারাতে পারি, সরকারি ভবনে প্রবেশের অনুমতি হারাতে পারি, এমনকি আমাদের অফিসিয়াল লাইসেন্স নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
যারা অর্থের অভাবে নিজের অধিকার রক্ষা করতে পারে না—
ইমিগ্রান্ট, দরিদ্র মানুষ, ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা।
টেক্সাস, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি-র মতো জায়গায় অসংখ্য এনজিও বলছে, আগে বড় ফার্মগুলো তাদের সঙ্গে যেভাবে কাজ করত, এখন সেটা আর করছে না।
ইমিগ্রেশন ইক্যুয়ালিটি নামের একটি সংগঠনের কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা সাধারণত জিতি, কারণ আমাদের মামলাগুলো শক্তিশালী। কিন্তু এখন মামলা করাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বড় ফার্মগুলো সরে গেছে।”
প্রো-বোনো মানেই কেবল দয়া নয়, এটা পেশার নৈতিক দায়িত্ব
“প্রো-বোনো” শব্দটা এসেছে ল্যাটিন থেকে, মানে— জনস্বার্থে কাজ করা।
এই চর্চাটি আমেরিকান আইনি পেশার একটি গর্ব। হাজার হাজার আইনজীবী প্রতিবছর লাখ লাখ ঘণ্টা সময় দেন গরিব-দুঃখীদের আইনি সহায়তা দিতে।
কিন্তু এখন এটি যেন রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
স্টিভেন ব্যাঙ্কস, নিউ ইয়র্কের একটি বড় ফার্মের প্রাক্তন প্রো-বোনো প্রধান, ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,
“মামলায় জিতি বা হারি, ট্রাম্পের উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে—মানুষকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া।”
বড় ফার্মগুলো কী করছে?
কেউ কেউ সরকারকে খুশি রাখতে ১ বিলিয়ন ডলারের বিনা পারিশ্রমিকের কাজ করতে রাজি হয়েছে, শর্ত একটাই— ট্রাম্প প্রশাসনের পছন্দসই ইস্যুতে কাজ করতে হবে।
অনেকে তাদের ওয়েবসাইট থেকে ইমিগ্রেশন, ডাইভার্সিটি বা মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিবরণ সরিয়ে ফেলেছে।
কিছু ফার্ম "গোপনে" সহায়তা দিচ্ছে—নাম ব্যবহার না করে, কোনও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।
ডিসির একটি সংস্থার পরিচালক বলেন, “১৫ বছর ধরে আমি ১,০০০’র বেশি প্রো-বোনো চুক্তি দেখেছি। কিন্তু এবারই প্রথম এমন চুক্তি দেখলাম যেখানে বলা হয়েছে— আমাদের নাম ব্যবহার করা যাবে না!”
যারা মাথা নত করেনি, তারাও আছে
সব ফার্ম কিন্তু নত হননি।
WilmerHale, Jenner & Block, Perkins Coie-এর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান ট্রাম্প প্রশাসনের আদেশকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং জয়লাভ করেছে।
তবে সংখ্যায় তারা এখনো সংখ্যালঘু।
এই সবকিছুর মানে কী?
একটা গভীর প্রশ্ন উঠে আসে—
আমরা কি এমন এক দেশে পরিণত হচ্ছি যেখানে আইনজীবীরাও ভয়ে কথা বলতে পারে না?
জেবি হাওয়ার্ড, এক আইনজীবী যিনি পদত্যাগ করেছেন, বলেন,
“আমাদের পেশার মূল ভিত্তি ন্যায়বিচার ও সাহস। যদি সেটা না থাকে, তাহলে আমরা কাদের পক্ষে কাজ করছি?”
আইনজীবী সমাজ সবসময় সমাজের প্রান্তিকদের শেষ ভরসা।
আজ যখন সেই ভরসাটাই কাঁপছে রাজনৈতিক চাপের মুখে, তখন প্রশ্ন শুধু আইন বা আদালতের না—
প্রশ্ন আমাদের বিবেকের, মানবিকতার, এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের।
মারিয়া