
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাসাদ, যার গায়ে সময়ের ধুলা জমলেও ইতিহাসের দীপ্তি একটুও ম্লান হয়নি। নাম—রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি। অনেকেই একে ‘রাজপ্রাসাদ’ বললেও এটি নিছক একটি দালান নয়; এটি একসময়কার জমিদারি ঐশ্বর্যের জীবন্ত নিদর্শন।
ব্রিটিশ শাসনের রমরমা সেই সময়, যখন বাংলা জুড়ে জমিদাররা ছিলেন স্থানীয় রাজা কিংবা রাজারও রাজা। রাজা টংকনাথ ছিলেন সেই সময়ের প্রভাবশালী জমিদারদের একজন, যাঁর প্রভাব শুধু রানীশংকৈলে সীমাবদ্ধ ছিল না—তার বিস্তৃতি ছিলো মালদহ, দিনাজপুর এবং ভারতের কোচবিহার পর্যন্ত।
এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল রাজবংশের আবাস ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে। স্থাপত্যে ভারতীয় উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক ধাঁচ এবং ইউরোপীয় ‘ভিক্টোরিয়ান’ ছোঁয়া স্পষ্টভাবে মিশে আছে। মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে দোতলা লাল ইটের ভবন, সুউচ্চ কলাম, খিলানযুক্ত বারান্দা, আর কাঠের অলঙ্কারখচিত দরজা-জানালা—যেন এক নিঃশব্দ জাদুকরী জগত।
রাজবাড়িটির প্রতিটি করিডোর, ঘর ও বারান্দা কথা বলে। ভেতরের মেঝেতে ব্যবহৃত হয়েছে সাদা-কালো মার্বেল। সিঁড়িগুলো গোলাকার ধাঁচে বাঁকানো—যার গায়ে এখনও ঘোড়ার ক্ষুরের দাগ দেখা যায় বলে দাবি করেন স্থানীয় প্রবীণরা।
বাড়িটির পেছনে ছিল "রানী মহলের" অংশ, যা আজ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু এখনও টিকে থাকা দেয়ালে দেখা মেলে ফুল-পাতার অলঙ্করণ, যা হাতে আঁকা হয়েছিল বলে ধারণা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, শত বছরের পুরনো এই রাজবাড়িটি আজকাল উপেক্ষিত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। সময়ের ব্যবধানে এটি ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে। স্থানীয় তরুণরা মাঝে মাঝে এখানে শর্টফিল্ম শুট করে, কিছু দর্শনার্থী আসে ছবি তুলতে, কিন্তু সরকারিভাবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
স্থানীয় একজন প্রবীণ শিক্ষক, মো. ফজলুল হক বলেন,
"এটা শুধু একটা বাড়ি না, আমাদের শিকড়ের স্মারক। যদি সংরক্ষণ করা যেত, তাহলে এখান থেকে শিক্ষা, পর্যটন, এমনকি ইতিহাস গবেষণার বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হতো।"
বর্তমানে এই রাজবাড়িটি রানীশংকৈলের অন্যতম ‘লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা রত্ন’। সঠিক পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পেলে এটি হতে পারে উত্তরবঙ্গের বড় পর্যটন আকর্ষণ। স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে ইতিহাস শেখার সুযোগ পেত, আর এলাকাবাসীও উপকৃত হতো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে।
রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি শুধু একটি ঐতিহাসিক ভবন নয়, এটি হলো উত্তর বাংলার এক ভূতপূর্ব অধ্যায়ের দালিলিক দলিল। আমাদের চোখের সামনে এটি ধ্বংসের মুখে, অথচ এর গল্পগুলো এখনও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। প্রয়োজন শুধু শ্রবণের মনোযোগ আর রক্ষার সদিচ্ছা।
রানীশংকৈল দেখার হলে, রাজবাড়ির গল্প শোনা জরুরি। কারণ ইতিহাস হারালে, হারিয়ে যাই আমরা নিজেরাই।
Jahan