
ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) জাতীর সন্ধিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি নব্বইয়ের সৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে ডাকসুর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এর পর ডাকসুর নেতৃত্বে আর কোনো বড় আন্দোলন বা ডাকসুর পক্ষ থেকে কোনো বড় ধরনের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
২০১৯ সালে ২৮ বছর পর পুনরায় ডাকসু নির্বাচন হলেও চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মকা- করতে পারেনি ডাকসু নেতৃবৃন্দ। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে সর্বস্তরের ছাত্র জনতা মাঠে ভূমিকা পালন করে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করে।
আওয়ামী লীগকে হঠাতে ভূমিকা পালন করা সেই শিক্ষার্থীরা এখনো অধ্যয়ন করছেন। ফলে এবারের ডাকসু নির্বাচন হবে একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকে। কিন্তু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্তমানে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ ডান-বাম আরও অনেক সংগঠনের কার্যক্রম চলছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচনে আসলে কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এমন আলোচনাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সর্বত্র। এমনকি এ আলোচনা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে ছাপিয়ে সারা দেশে রাজনৈতিক সচেতন মানুষদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা তৈরি করেছে।
ছাত্র সংগঠনের নেতারা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন পর্যাপ্ত সংস্কার না করে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও তারা নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তবে নির্বাচন নিয়ে বিশদ কোনো আলোচনায় তারা এখনো বসতে পারেননি। এমনকি কারা তাদের পক্ষ থেকে ডাকসুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এসব বিষয় নিয়ে তারা কোন আলোচনা করতে পারেননি। তবে শীঘ্রই ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচন নিয়ে তাদের দলীয় ফোরামে বসবেন।
ইতোমধ্যে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত এবং গ্রুপে আলোচনায় মগ্ন। ছাত্র সংগঠনগুলো কোনো প্রার্থী এখন পর্যন্ত ঠিক করতে না পারলেও ক্যাম্পাসে কিছু প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছে।
ছাত্রদলের পক্ষ থেকে কোনো নাম ঘোষণা না করলেও শিক্ষার্থীদের আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান ও বি এম কাওসার এবং কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক তানভীর বারী হামিমের নাম আলোচিত হচ্ছে ।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক ঢাবি সভাপতি আবু সাদিক কায়েম ও বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন।
এছাড়া গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার, সদস্যসচিব জাহিদ আহসান ও মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসির চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহিও আলোচনায় রয়েছেন।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জাবির আহমেদ এবং ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লার নামও শোনা যাচ্ছে।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কাউসার আহমেদ বলেন, আমরা বন্ধুরা মিলে আলোচনা করে বেশ কয়েকটি নাম পেয়েছি যারা ক্যাম্পাসে জুলাই আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে সবসময় ছিলেন। ছাত্রবান্ধব এসব নেতা ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হলে নির্বাচন চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূূলক হবে।
‘আমরা শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করব। যারা শিক্ষার্থীদের বিপদে আপদে কাছে থাকবেন, সত্যকে সত্য বলবেন এমন প্রার্থীকেই আমরা বেছে নেব।’
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দলীয় লেজুড়ভিত্তিক প্রার্থী চাই না। ছাত্রদের নিয়ে কাজ করবে এমন প্রার্থী চাই কোনো দলের হয়ে কাজ করবে না।
‘হলকেন্দ্রিক দলীয় রাজনীতি আমরা চাই না। গণরুম, হলে দলের আধিপত্য নতুন করে তৈরি করবে এমন প্রার্থীকে আমরা ভোট দেব না।’
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জাতির মুক্তির সকল আন্দোলন এ ডাকসুকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। আগামীতেও ডাকসুর নেতৃবৃন্দই বাংলাদেশকে পরিচালনা করবে। সংকটময় এ সময়ে ডাকসু নির্বাচন নতুন নেতৃত্বের দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ডাকসু নির্বাচনের তফসিলকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি। কিন্তু ডাকসুর যিনি সভাপতি তিনিই অনির্বাচিত। স্বৈরাচারের দোসর শিক্ষক, কর্মকর্তাদের বিচার হয় নাই। ছাত্রলীগের পদধারী এবং জুলাই আন্দোলনে যারা বাধাগ্রস্ত করেছে সেসব ছাত্রলীগ নামধারী ছাত্ররা ভোটার হয়েছে। এগুলো আমাদের ভাবায় এবং ডাকসু নির্বাচনটি আরো গোছাল হতে পারত।
তারপরেও আমরা আশা করব এবারের নির্বাচনটি ২০১৯ সালের নির্বাচনের মতো বিতর্কিত না হোক। নির্বাচন বিতর্কমুক্ত করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন তা নেবে বলে আমাদের বিশ^াস।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা জনকন্ঠকে বলেন, আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী। অতীতে বিশ^বিদ্যালয়ে এবং রাষ্ট্রে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে মাঠে ছিলাম। আমি আসলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে একটি মডেল বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই । আমি নির্বাচিত হলে কিছু পদক্ষেপ নেব যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভবিষ্যত জবের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।
মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চাই। এমন নেতৃত্ব চাই যা দল মতের উর্ধ্বে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে। একাত্তরের পর ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষ আকাঙ্ক্ষিত নেতৃত্ব পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টিও একই। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল তা খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি হারাতে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত নেই। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল তা রাখা সম্ভব হয়নি।
ডাকসুই পারে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে। অভ্যুত্থানের সময় আমাদের আকাক্সক্ষার জায়গা ছিল আমরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলব, মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাব। আমরা এর জন্যই অভ্যুত্থানে লড়েছিলাম। আমি আশা করছি ডাকসুর মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সে কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করবে।
নির্বাচনের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ ॥ আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ভোটার তালিকার বিষয়ে আপত্তি জানানোর শেষ তারিখ ৮ আগস্ট। এরপর আগামী ১১ আগস্ট চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এতে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রীর মধ্যে সর্বাধিক ভোটার রয়েছেন রোকেয়া হলে মোট ৫ হাজার ৬৭৬ জন; যা ঢাবির সবচেয়ে পুরনো হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের (মোট ভোটার ৫৫৯ জন) তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। ছাত্রীদের হলের মধ্যে রোকেয়া হলের পরই রয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হল; যেখানে ভোটার সংখ্যা ৪ হাজার ৪৯৫ জন। শামসুন নাহার হলে ৪ হাজার ৯৮ জন, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ২ হাজার ১০৮ জন এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ২ হাজার ৬৫১ জন। সব মিলিয়ে ছাত্রী ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ২৮ জনে, যা মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, ছাত্রদের মধ্যে সর্বাধিক ভোটার রয়েছে জগন্নাথ হলে- ২ হাজার ২৫৪ জন। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ১ হাজার ৬০০, কবি জসীম উদ্দীন হলে ভোটার সংখ্যা ১ হাজার ২৯৮, অমর একুশে হলে ১ হাজার ৩১৯, ফজলুল হক মুসলিম হলে ১ হাজার ৭৭৯, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ২ হাজার ১৭, বিজয় একাত্তর হলে ২ হাজার ১৩, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ১ হাজারে ৭৩৫, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে রয়েছে ১ হাজার ৯৬১ জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৫৫৯, সূর্যসেন হলে ১ হাজার ৪৯৫ জন, স্যার এ এফ রহমান হলে ১ হাজার ৪৮০ ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে রয়েছে ১ হাজার ৩৯৪জন ভোটার। সব মিলিয়ে ছাত্র ভোটারের সংখ্যা ২০ হাজার ৯০৪ জন, যা মোট ভোটারের ৫২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের ডাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৯৩২ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১৯ হাজার ২৮ জন (৪৭.৬৫ শতাংশ) এবং ছাত্র ২০ হাজার ৯০৪ জন (৫২.৩৫ শতাংশ)।
তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হবে ১২ আগস্ট। ১৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৯ আগস্ট বেলা ৩টা।মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে ২০ আগস্ট। এরপরপ্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে ২১ আগস্ট দুপুর ১২টায়। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টা। প্রার্থীদের চূড়াস্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ২৫ আগস্ট বিকেল ৪টায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল সংসদ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১৩টি পদে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পদগুলো হলো সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহ সাধারণ সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক, সংস্কৃতি সম্পাদক, পাঠকক্ষ সম্পাদক, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া সম্পাদক, বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক, সমাজসেবা সম্পাদক, সদস্যদের ৪টি পদ।
প্যানেল হু