ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জ

আল জুবায়ের

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ৩০ জুলাই ২০২৫

‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জ

কোটা সংস্কার আন্দোলন

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জুলাইয়ের শেষ দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গণগ্রেপ্তার এবং আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা, হত্যা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচি ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ ঘোষণা করা হয়। 

আন্দোলনের সহসমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, এ কর্মসূচি অনুযায়ী ১ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) শিক্ষার্থী নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতের স্মৃতিচারণ করা হবে। শহীদ ও আহতদের নিয়ে পরিবার এবং সহপাঠীরা স্মৃতিচারণ করবেন। শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে চিত্রাঙ্কন, গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন, ডিজিটাল পোর্ট্রেট প্রভৃতি তৈরি করা হবে। 
এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচি পালনকালে পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গ্রেপ্তার করা হয় শতাধিক বিক্ষোভকারীকে। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্থানে আহত হন অন্তত ৯০ জন। 
এর আগের রাতে টেলিগ্রাম অ্যাপে কোটা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের মুক্তি, শিক্ষার্থী হত্যা, গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তিসহ ৯ দফা দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের। 
মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্টের মাজার গেট এলাকায় জড়ো হন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। পরে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হাইকোর্টের ভেতরে আইনজীবীদের একটি দলও মিছিল করেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ বেলা একটার দিকে মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পরে তারা দোয়েল চত্বরে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশ করেন। বেলা তিনটার দিকে সেখান থেকে চলে যান তারা।
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও অংশ নেন। এদিন বেলা একটার দিকে কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনসংলগ্ন মহুয়া মঞ্চের সামনে জড়ো হন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে তারা সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। 
অন্যদিকে সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। পরে বাধা পেরিয়ে যাওয়ার সময় সাউন্ড গ্রেনেড ও কঁঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।
৩১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রশ্নে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দু’পক্ষ। দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে প্রথমে সংগঠনটির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে সমিতির সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা স্থগিত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম দফার এ আলোচনা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির আলোকে আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে বলে ইইউর এক মুখপাত্র জানান। 
ছাত্রদের কোটা আন্দোলন ও দেশের পরিস্থিতি সহিংস হওয়ার মধ্যেই অনেক মন্ত্রী-এমপি দেশ ছাড়েন। পরিস্থিতি নাজুক দেখে বিদেশ থেকে ফ্লাইটের টিকিট কেটে ঢাকা ছাড়েন অনেক প্রভাবশালী। তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন ও দুবাই পাড়ি জমান। এ ছাড়াও ১৪ দিন পর দুপুর ৩টার পর বাংলাদেশে সচল করা হয় ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। 
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে ‘আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের’ মতো বিষয়গুলোতে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক ওই চিঠিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানায় ভবিষ্যৎ নির্যাতন বন্ধে দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপত্তা খাতের সংস্কার জরুরি। 
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায় নব্বইয়ের ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের দুই সিনেটর। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ওয়াশিংটন থেকে জারি করা বিবৃতিতে মার্কিন সিনেটর বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির নিন্দা জানান। 
৩১ জুলাই বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে তিনি রাষ্ট্রদূতকে জানান, ‘সহিংসতাকারীরা আসলে তার (শেখ হাসিনা) সরকারকে উৎখাতের জন্য শ্রীলঙ্কায় যেমনটি ঘটেছিল, ঠিক সে রকম পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা (নৈরাজ্যকারীরা) শ্রীলঙ্কার মতো সহিংসতা সৃষ্টি করে সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছে।’
এদিকে ৩১ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে ডিবির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার করা হয়। হারুনের স্থলে ডিবির নতুন দায়িত্ব পান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মহা. আশরাফুজ্জামান। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারাদেশে ১৫ দিনে গ্রেপ্তার করা হয় ১০ হাজার ৭৩৫ জনকে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত সারাদেশে গ্রেপ্তার করা হয় আরও ৩৪১ জনকে। এ নিয়ে রাজধানীতে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫০ জনে।

প্যানেল হু

আরো পড়ুন  

×