
ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের কামচাটকা উপদ্বীপে কিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরিতে উদ্গীরণ শুরু হয়
রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের কামচাটকা উপদ্বীপে বুধবার ভোরে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ভূমিকম্পের পর কিছু অংশে ৩-৪ মিটার (১০-১৩ ফুট) উচ্চতার সুনামি রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া জাপানেও ৩০ সেমি উচ্চতার ঢেউ রেকর্ড করা হয়। ভূমিকম্পের জেরে বিশ্বের মোট ১৪টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এদিকে ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার প্রত্যন্ত কামচাটকা অঞ্চলে ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছে।
দেশটির বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির ভূতাত্ত্বিক বিভাগের স্থানীয় শাখা এই অগ্ন্যুৎপাতের তথ্য নিশ্চিত করেছে। ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিক কোনো হতাহতের খবর জানা না গেলেও সুনামির কারণে রাশিয়ার সেভেরো কুরিলস্কে বন্দরের অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি জাহাজকে সমুদ্র প্রণালিতে টেনে নিয়ে গেছে। খবর বিবিসি ও আলজাজিরার।
রাশিয়ায় ভূমিকম্পের জেরে এখন পর্যন্ত যেসব স্থানে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রাশিয়া, জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, চীন, হাওয়াই, গুয়াম, ক্যালিফোর্নিয়া, চিলি, আলাস্কা, ওরেগন, ওয়াশিংটন, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, মেক্সিকো, পেরু, ইকুয়েডর ও নিউজিল্যান্ড রয়েছে। ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার সুদূর পূর্বাঞ্চলের কামচাটকা উপদ্বীপের ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরিতে উদগিরণ শুরু হয়েছে। আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ছাইয়ে আকাশ ঢেকে গেছে, যা এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ কিলোমিটার (১.৮ মাইল) উচ্চতায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ক্লিউচেভস্কয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের রুট না থাকলেও আঞ্চলিক ফ্লাইটের জন্য রাশিয়ার বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি করেছে। রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের ভলকানোলজি ও সিসমোলজি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, আগ্নেয়গিরির মুখ প্রায় লাভায় পূর্ণ হয়ে গেছে। যে কোনো সময় লাভা গড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে রাশিয়ার বন্দর শহর সেভেরো কুরিলস্কে তিনটি সুনামির ঢেউ আঘাত হানে বলে জানিয়েছে বিবিসি। এতে বন্দর অবকাঠামো এবং জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার বন্দর শহর সেভেরো কুরিলস্কে তিনটি সুনামির ঢেউ আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে রাশিয়ার তাস সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, তৃতীয় তরঙ্গটি শক্তিশালী ছিল।
এদিকে জাপানের উত্তরাঞ্চলীয় হোক্কাইডো শহরে ৩০ সেমি (১২ ইঞ্চি) উচ্চতার প্রথম ঢেউ আঘাত হানে এবং কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে দিয়েছে যে পরবর্তী ঢেউ আরও বড় হতে পারে। ছবিতে দেখা গেছে, জাপানে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশের পর সবাই ভবনে উঠে যাচ্ছে। ২০১১ সালের সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পের পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ আলাস্কা এবং হাওয়াইয়ের জন্য সুনামি সতর্কতা জারি করে।
হাওয়াই ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের পাশাপাশি মার্কিন দ্বীপপুঞ্জ গুয়াম এবং মাইক্রোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জে বিভিন্ন স্তরের সতর্কতা জারি করা হয়। হাওয়াইয়ের জন্য কার্যকর সুনামি সতর্কতায় বলা হয়েছে যে, উত্তর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কিছু উপকূলে স্বাভাবিক জোয়ারের স্তর থেকে ৩ মিটার (১০ ফুট) বেশি উচ্চতার সুনামি ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে, যা আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শুরু হবে। পেরু এবং ইকুয়েডরের কাছে অবস্থিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জেও সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে, যেখানে কিছু প্রতিরোধমূলক স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি পূর্ব চীনের কিছু অংশে সুনামির ঢেউ আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১৯০০ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ভূমিকম্পের রেকর্ড রাখা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস)। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব জরিপ সংস্থার ওয়েবসাইটে গত ১২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ১০টি ভূমিকম্পের তালিকাও দেওয়া হয়েছে।
সেই তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, শক্তিমত্তা ও ধ্বংসের বিচারে ১০ম স্থানে রয়েছে ২০১২ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে ঘটা ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পটি। সেই ভূমিকম্পে সুমাত্রাজুড়ে ব্যাপক ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছিল। তবে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। হাতেগোনা যে কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগেরই মৃত্যুর কারণ ছিল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। ৯ম স্থানে আছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচলে ১৯৫০ সালে ঘটা ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পটি।
অসম এবং তিব্বত অঞ্চলেও এর কম্পন তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছিল বলে এটি অসম-তিব্বত ভূমিকম্প নামেও পরিচিত। ব্যাপক কম্পন, ভূপৃষ্ঠ ফাটল এবং বিশাল এলাকাজুড়ে ধসের জেরে সেই ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৭৮০ জন। অষ্টম ভূমিকম্পটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের র্যাট দ্বীপে ১৯৬৫ সালে এবং সেটির মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। তবে সেখানে জনবসতি না থাকায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সপ্তম ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৯০৬ সালে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের এসরোলডাস শহরে। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভূমিকম্প প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ১ হাজার ৫০০ মানুষের। ভূমিকম্পটির মাত্রা প্রশান্ত মহাসগারের অপর তীর সান ফ্রান্সিসকোতেও অনুভূত হয়েছিল। ষষ্ঠ ভূমিকম্পটি হয়েছিল ২০১০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার অপর দেশ চিলির বিওবিও প্রদেশের কিউরিহিউ শহরের কাছে। ৮ দশমিক ৮ মাত্রার সেই ভূমিকম্প প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ৫২৩ জনের, ধ্বংস করেছিল ৩ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর। পঞ্চম ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৯৫২ সালে রাশিয়ার কামচাটকা ক্রাই উপদ্বীপে।
এটি ছিল বিশ্বে রেকর্ডকৃত প্রথম ৯ মাত্রার ভূমিকম্প, যার ধাক্কা এসে লেগেছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্য পর্যন্ত। ভূমিকম্পের জেরে হাওয়াইয়ে ব্যাপক সুনামিও হয়েছিল। এই ভূমিকম্পে প্রাণহানির কোনো তথ্য পাওয়া যয়নি তবে। তখনকার সময়ে ১০ লাখ ডলারেরও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল রাশিয়ায়। চতুর্থ ভূমিকম্পটি হয়েছিল জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপে ২০১১ সালে। ৯ দশমিক ১ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি। তৃতীয় ভূমিকম্পটি হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে ২০০৪ সালে।
৯ দশমিক এক মাত্রার সেই ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন ১০ লাখ ১০ হাজার জন। দ্বিতীয় ভূমিকম্পটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় ১৯৬৪ সালে। ৯ দশমিক ২ মাত্রার সেই ভূমিকম্প এবং তার জেরে সৃষ্ট সুনামিতে নিহত হয়েছিলেন ১৩০ জন এবং আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ২৩০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।
বিশ্বের ইতিহাসে এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৯৬০ সালে চিলির বিওবিও প্রদেশে। ৯ দশমিক ৫ মাত্রার সেই ভূমিকম্পে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ৬৫৫ জন মানুষ এবং বাড়িঘর ভাঙার জেরে আশ্রয়হীন হন আরও ২০ লাখ মানুষ।
প্যানেল হু