ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তন ও চলমান তাপপ্রবাহ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ 

সাইফুল ইসলাম স্বপ্নীল

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ৬ মে ২০২৪

জলবায়ু পরিবর্তন ও চলমান তাপপ্রবাহ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ 

জলবায়ু পরিবর্তন।

বছর কয়েক আগে সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের ফ্রাইডে ফর ফিউচার আন্দোলনের কথা মনে পড়ে? যার পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবীতে ধরিত্রী মাতা রক্ষার আন্দোলন বাড়তি মাত্রা পায়। ছোট্ট কোমলমতি শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ প্রভাব এবং হুমকি সম্পর্কে খুবই উদ্বিগ্ন। থুনবার্গের এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, 'বড়রা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমরা ছোটরা কোন দোষ না করেও এর ক্ষতিকারক প্রভাব ভোগ করতে হবে'। 

গ্রেটার মতে, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রীন হাউজ গ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।তরুণদের ভবিষ্যত ঝুঁকির মধ্যে ফেলার জন্যও বিশ্বনেতৃবৃন্দের কঠোর সমালোচনা করেন গ্রেটা।বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ ডেভিড ওটেনবরো গ্রেটার ভূয়সী প্রশংসা করলেও মৃদু সমালোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন,প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। কিছুদিন আগেও নেদারল্যান্ডে জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকীর প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে দুইবার গ্রেফতার হন গ্রেটা।

বাংলাদেশসহ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল গুলোতে চলমান তাপ প্রবাহে বিশেষজ্ঞগণ শংকিত। তারা বলছেন ২০২০-২০২২ সালে লা নিনোর পরবর্তী প্রভাব এল নিনোর কারণে ২০২৩ সাল থেকে  উল্লেখিত অঞ্চলে অত্যধিক উষ্ণতার প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশের যশোরে গত ৫ দশকের রেকর্ড ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। দেশব্যাপী হিট এলার্ট জারি করা হয়েছে। হিট স্ট্রোকে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতীয় ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। ভারতের উত্তর অঞ্চলে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলেও মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে তাপমাত্রা চার গুণ অতিক্রম করেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক গবেষণা, নিবন্ধ,বিশ্লেষণ,কনফারেন্স ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব সম্মেলনে প্রতিবছরই গ্রিন হাউজ গ্যাস যেমন  কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন,সালফার ডাই অক্সাইড, সিএফসি নিঃসরণের কথা বলা হয়। সর্বশেষ কপ-২৮ সম্মেলনে চমকপ্রদ একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। পরিবেশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত অনেক সংগঠনই দীর্ঘদিন যাবত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দাবি জানিয়ে আসছিল। দুবাইতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি ঝুঁকে পড়বে বলে অঙ্গীকার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন ভারত সহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি, পানি শক্তি, বায়ু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন  করবে আশ্বাস দিয়েছে। অনেক দেশেই ইলেকট্রিক গাড়ি ইতোমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। চুক্তিতে উল্লিখিত প্রস্তাবনা গুলোর পর্যায়ক্রমে বন্ধের পরিবর্তে দিবসের জ্বালানি ব্যবহার ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনার প্রতি জোর দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ ইউনিয়ন ও ক্ষুদ্রদ্বীপ রাষ্ট্রগুলো।

সম্মেলনে প্রতিবারই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, জলবায়ু তহবিল,কিয়োটো প্রটোকলের আওতায় কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমানো, অন্যান্য গ্রিনহাউস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হলেও এর স্থায়ী সমাধান পাওয়া যায়নি। শিল্প উন্নত দেশগুলো তাদের কথা রাখেনি। মহাসাগরীয় ক্ষুদ্র দ্বীপ ফিজি,নাউরু,মালদ্বীপ, মরিশাস এর মত রাষ্ট্রগুলো, উপকূলীয় বিভিন্ন রাষ্ট্র তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করলেও শিল্প উন্নত ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তাতে কর্ণপাত করছে না। 

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বরিশাল অঞ্চলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে উপকূলীয় ও ঢালচর, সন্দীপ, হাতিয়া, মনপুরা অন্যান্য দীপাঞ্চলে নদীভাঙ্গন ও সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই অঞ্চলে জলবায়ু শরণার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম বড় শহরগুলোতে ভিড় করছে।খুবই পরিতাপের বিষয় যে বিশ্বের শিল্প উন্নত ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ৯৭ পারসেন্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করলেও বাংলাদেশ মাত্র .৪৭ পার্সেন্ট গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে। কিন্তু এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো।রেডিয়াম গ্রুপের ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ২৭% চীন, ১১% যুক্তরাষ্ট্র ও ৬.৬ শতাংশ ভারত  গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশে যে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো জলোচ্ছ্বাস অন্যতম।বিশেষত গত দেড় দশকে প্রতিবছরই এক বা একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় তীব্রভাবে আঘাত হেনেছে।২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডবলীলার পর একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। যার মধ্যে আইলা, মহাসেন, বুলবুল, ফণী, রোয়ানু, মোরা,রেশমি অন্যতম।আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে উপকূলীয় মানুষগুলো এখনো অসহায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।  বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ঘূর্ণিঝড় এখন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের  উচ্চতা বৃদ্ধি ও হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হয় দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল হাওর এলাকায়। বিশেষ করে সিলেট,সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা হয়। ক্ষতির মুখে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অনেক দিন  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়ে সাধারণ  শিক্ষার্থীরা।। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম।

আইপিসিসি এর গবেষণায় দেখা গেছে, ধরিত্রীর এক যুগের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রান্ত হতে পারে। যা প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার চেয়েও বেশি।এতে করে আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে, বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা এবং লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। সংগঠনটি উষ্ণায়ন কমাতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে-

১. ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে হাটা সাইক্লিং হতভাগ গণপরিবহন ব্যবহার।
২. ওয়াশিং মেশিন, এসির যত্রতত্র ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির সুষ্ঠু ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। 
৩. মাংস ও মাংসজাত খাবারের পরিবর্তে শাকসবজি, লতাপাতা তথা নিরামিষভোজী হতে হবে। 
৪. প্রতিটি ভোগ্যপণ্য ও পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
৫. টেকসই কমিউনিটি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভালো অভ্যাসগুলো অন্যদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।

×