
দেশেই মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী
বৈশ্বিক অস্থিরতায় সকল দেশেই মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী। সাধারন মানুষের নাভিশ্বাষ দীর্ঘ হচ্ছে। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ তেলের মূল্যবৃদ্ধি, যা সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কেননা অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টর একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে পরিবহন ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ কারনে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য বিক্রেতারা আরও বাড়িয়েছে। পারিবারিক বাজেটেও দেখা দিয়েছে গড়মিল। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় করা মুশকিল হয়ে গেছে।
নিম্নবিত্তরা দরিদ্র হচ্ছে, মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তের কাতারে আর ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। দেশে বর্তমানে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে প্রচুর অর্থ রয়েছে। এছাড়া যেসব জনসাধারণ আছে তাদের আয় বাড়ছে না তবে ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ইতোমধ্যে করোনার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই নাজুক হয়েছে। এরপর সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও ধীরে ধীরে মানুষ মানিয়ে নিচ্ছিল। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি।
একধাক্কায় অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের দ্বিগুণ মূল্যবৃদ্ধি। ফলে বিক্রেতারা পরিবহন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে পণ্যের মূল্য বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। এমনিতেই দেশে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের জ্বাল ভেদ করা অদ্যবধি সম্ভব হয়নি। এরা অতিরিক্ত লাভের আশায় বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োঅজনীয় পণ্যের মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এই যাতাকলে সাধারণ মানুষ প্রায়ই পিষ্ঠ হয়। এবার বাজার ঘুড়ে দেখা গেল, দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির পেছনে একটিই যুক্তি দিচ্ছে ক্রেতারা তা হলো পরিবহন ব্যয় বেড়েছে।
গৃহিণী শারমিন আক্তার সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাওরান বাজারে এসেছেন সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু পণ্য ক্রয়ে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কিছুদিন আগেও বাসার সামনের মুদিদোকান থেকে সকল পণ্য কিনতাম। কিন্তু সবকিছুর দাম অনেক বেড়েছে, তাই এই বাজারে চলে এলাম কম খরচের আশায়। তবে যে টাকা নিয়ে বাজারে এসেছি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার আগেই টাকা শেষ হয়ে গেল।
এতকাল মাসশেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারতাম। এখন বুঝি সেটাও সম্ভব হবে না। একদিকে বাসাভাড়া ও গ্যাসবিল বেড়েছে। অন্যদিকে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাপন কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই মনে হয় গ্রামের বাড়ি চলে যাই। কিন্তু বাচ্চাদের বাবার থাকা-খাওয়ায় কষ্ট হবে বিধায় যেতে পারছি না। এভাবে আর কতকাল চলতে পারব জানি না।
সন্ধ্যার পরে মগবাজার সুপারশপ স্বপ্ন থেকে বের হচ্ছিল শাম্মি ইসলাম নামের এক ব্যাংক কর্মী। বর্তমান মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে শাম্মি ইসলাম বললেন, আয় বাড়ছে না তবে ব্যয় এতটা বেড়েছে যা বলার ভাষা নেই। আমার বেতন কিন্তু হঠাৎ করেই বাড়বে না। তবে বাসার সহকর্মী থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে খরচ বেড়েছে। এমনকি বাচ্চাকে যে ভ্যানচালক আনা নেয়া করছে সেও তার ভ্যান ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমি ও আমার হাসবেন্ড দুজনেই চাকরি করছি। বাচ্চাদের ভাল একটি স্কুলে পড়াই। মোটামুটি একটা সামাজিক অবস্থান মেইনটেইন করতে হয়। চাইলেই এগুলো বাদ দিয়ে চলা সম্ভব না। আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পরে যাচ্ছি। এগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করাও সম্ভব না।
চলতি মাসের ৫ আগস্ট মধ্যরাতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের খুচরা দাম ৮০ টাকা থেকে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। লিটার প্রতি অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং ৮৬ টাকা থেকে ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে পেট্রোলের। জ্বালানি তেলের ্এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সব শ্রেণীর ভোক্তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। আর রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি না ঘটলে, এই পরিস্থিতি থেকে সহজেই উত্তরণ হওয়া সম্ভব নয়।
যেহেতু সমস্যাটা বৈশি^ক তাই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সকল নীতি নির্ধারকদের অধিক সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন প্রয়োজন। কোনভাবেই যেন মধ্যস্বত্বশ্রেণী এই সঙ্কট কাজে লাগাতে না পারে এবং অচিরেই লোডশেডিং ও মূল্যস্ফীতিসহ অযাচিত সকল সমস্যা নির্মূল হবে এটাই প্রত্যাশা।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ডাটা ল্যাবের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১১তম। বর্তমানে এই তালিকার ২৮তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। উক্ত সময়ের মধ্যে এদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আওতাভুক্ত। গবেষণার তথ্য বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন করে মধ্যবিত্তের কাতারে যুক্ত হবে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার ৭ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ।
এ ছাড়া পাকিস্তানের ৫ কোটি ৯৫ লাখ, বাংলাদেশের ৫ কোটি ২৪ লাখ এবং ফিলিপিন্সের ৩ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ। অন্যদিকে মিসরের ২ কোটি ৯৬ লাখ, আমেরিকার ২ কোটি ৪২ লাখ, ভিয়েতনামের ২ কোটি ৩২ লাখ, ব্রাজিলের ২ কোটি ৬ লাখ, মেক্সিকোর ২ কোটি ১ লাখ মানুষ মধ্যবিত্তে যুক্ত হবে। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবককে বাজারে গিয়ে প্রতিনিয়তই পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়।
নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে অনেক ইচ্ছাই অপূরণীয় থেকে যায়। জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় এই মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীটিকে। সামাজিক সীমাবদ্ধতা ও আত্মসম্মানবোধের কারণে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত এই শ্রেণী। এরা পায় না সরকারীভাবে কোন সহযোগিতা। আবার কারও কাছে হাত পেতে সহযোগিতা কামনা করবে, এটিও পারে না। ফলে কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়।
তবে অর্থনীতির ভাষায় একটি দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। নেতৃত্বেও থাকে তারা। বিশ্বময় অর্থনীতিতে চলছে টালমাটাল অবস্থা, বাংলাদেশও সেই অবস্থার বাইরে নয়। প্রতিনিয়ত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য রসদ ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে। তাই মধ্যবিত্তদের বাড়তি বোঝা থেকে মুক্ত করতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অতীব আবশ্যক।